নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤্নচাপের কারণে প্রবল বর্ষণে তলিয়ে গেছে যশোরের নি¤্নাঞ্চল। রোববার সন্ধ্যা পর্যšত্ম ২৪ ঘণ্টায় যশোরে ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। টানা এই বর্ষণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে গোটা জেলাবাসী। টানা ভারী বর্ষণ এবং শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় ড্রেন উপচে রা¯ত্মাঘাট তলিয়ে নোংরা পানি প্রবেশ করেছে অসংখ্য বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পানি নিষ্কাশনের খাল ভরাট, কালভার্ট বেদখল ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পৌরসভায় গাফিলতিতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে গত ২৬ আগস্ট যশোরে টানা সর্বোচ্চ ২২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর গত ২৪ ঘণ্টায় এই বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হলো। এর আগে গত ৬ জুলাই যশোরে মৌসুমের সর্বোচ্চ ১২০ মিলমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, যশোরে বর্ষা মৌসুমের শুরম্নতে তেমন বৃষ্টিপাতের দেখা মেলেনি। আষাঢ়ের শেষভাগে গত ৬ জুলাই সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যšত্ম সর্বোচ্চ ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর ভাদ্র মাসে এসে কয়েক দফা বড়ধরণের বৃষ্টিপাত হলো। ১৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার) সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর (রোববার) সন্ধ্যা ৬টা পর্যšত্ম ২৪ ঘণ্টায় যশোরে ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে ২৫ আগস্ট ভোর ৬টা থেকে ২৬ আগস্ট দুপুর ২টা পর্যšত্ম যশোরে গত ৩২ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।
এদিকে, যশোর শহর ঘুরে দেখা গেছে, তিনদিনের টানা বর্ষণে গোটা নি¤্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ভারী বর্ষণে শহরের বেজপাড়া, টিবি ক্লিনিকপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, শংকরপুর, মিশনপাড়া, উপশহর, চাঁচড়া, কারবালা, এমএম কলেজ এলাকা, নাজিরশংকরপুর, বকচর, আবরপুরসহ শহরের নি¤্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। শংকরপুর, বেজপাড়া, খড়কি, কারবালা, স্টেডিয়ামপাড়ার অনেক বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার ড্রেন ছাপিয়ে উপচে পড়া পানি সড়ক পার হয়ে ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। ভেসে গেছে বিভিন্ন এলাকার পুকুর ও মাছের ঘের। এ মাছ ছড়িয়ে পড়ায় ড্রেন ও সড়কের উপরেই সৌখিন মৎস্যশিকারীদের তৎপরতাও দেখা গেছে।
পাশাপাশি শহরের অšত্মত ৩০টি সড়কে পানি জমে আছে। শহরের রেলরোডের ফুড গোডাউন থেকে টিবি ক্লিনিক মোড়-আশ্রম মোড় হয়ে মহিলা মাদরাসা পর্যšত্ম, খড়কি এলাকার শাহ আবদুল করিম সড়ক, স্টেডিয়ামপাড়া, শহরের পিটিআই, নাজির শংকরপুর, খড়কি রূপকথা মোড় থেকে রেললাইন, ফায়ার সার্ভিস মোড় থেকে পাইপপট্টি, বেজপাড়া চিরম্ননিকল, মিশনপাড়া, আবরপুর ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, ষষ্ঠীতলাপাড়ার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও শহরের ছোট ছোট সড়কেও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এসব সড়কের দুই পাশের ড্রেনের ময়লা-আবর্জনার নোংরা পানি উপচে পড়ে সড়কে। সড়ক ছাপিয়ে সেই পানির ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও। দুপুরের এ বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ে স্কুল ফেরত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পৌরসভার ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে অনেক মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। জলাবদ্ধতায় ভোগাšিত্মতে পড়েন ওই ওয়ার্ডের মানুষেরা।
শহরের ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের শংকরপুর চোপদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, তাদের গোটা এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পাানি উঠেছে। ঘরের ভিতরে হাঁটু পানি। আগে ড্রেনের মাধ্যমে এই পানি হরিণার বিলে নেমে যেতো। এখন সেখানে বড় বড় বিল্ডিং হওয়ায় ড্রেন বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নামতে পারছে না। কিন্তু শহরের পানি এই এলাকায় এসে জমা হচ্ছে।
বটতলা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, আগে শহরের পানি হরিণার বিল দিয়ে মুক্তেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু ২০১০ সালে হরিণার বিলে মেডিকেল কলেজ হওয়ার পর আশপাশে আরো অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এতে বিল দিয়ে পানি আগের মতো নিষ্কাশিত হতে পারছে না। ফলে এই এলাকা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে।
শংকরপুর এলাকার বাসিন্দা মাসুমা বেগম বলেন, এলাকার কয়েকশ’ বাড়িতে পানি উঠেছে। আমাদের বাড়ির নিচতলায় হাঁটুপানি জমেছে। টিউবওয়েলের কিছু অংশ পানিতে ডুবেছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছি আমরা। এদিকে রান্নাঘরেও পানি প্রবেশ করায় রান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে।’
শহরের খড়কির শাহ আবদুল করিম সড়কের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের দক্ষিণ গেট থেকে খড়কি মোড় হয়ে পীরবাড়ি, কবরস্থান পর্যšত্ম হাঁটু সমান পানি জমেছে। খড়কি দক্ষিণপাড়া-পশ্চিমপাড়া হাজামপাড়া, খড়কি রেললাইন পাড়ার বাসিন্দাদের বাড়ির উঠানে হাঁটু পানি। এই সড়কে চলাচলকারী রিকশা, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাসের যাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। আবার এই পানির মধ্যে দিয়ে রিকসা, ইজিবাইক যেতে রাজী না হওয়ায় অনেককে পায়ের জুতা হাতে নিয়ে হেঁটে চলাচল করতে দেখা যায়।
শহরের খড়কি এলাকার বাসিন্দা আজিজুর রহমান বলেন, যশোর পৌরসভার ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। ড্রেনগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ড্রেনগুলোও নাগরিকরা ডাস্টবিনে পরিণত করেছে। এগুলো নিয়মিত পরিস্কারও করা হয়নি। ফলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বেজপাড়া কবরস্থান এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন জানান, তাদের এলাকার ড্রেন উপচে নোংরা পানি রা¯ত্মায় থৈ থৈ করছে। অনেকের বাড়ি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ড্রেনগুলো পরিস্কার না করায় বৃষ্টির পানি নিস্কাশন হচ্ছে না। এজন্য পানি নামতে না পারায় গোটা এলাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির পর শহরের অনেক স্থানে রা¯ত্মার দুধারের দোকানগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। দোকানের ভিতরেই পানি থৈ থৈ করছে। দোকানিরা মগ, বালতি গিয়ে পানি নিস্কাশনের চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে সড়কে হাটু পানি জমেছে। সড়কের পাশে ড্রেন থাকলেও আবর্জনায় পূর্ণ হওয়ায় পানি উপচে সড়কে প্রবেশ করে। সড়কের সেই পানি আবার দোকানে প্রবেশ করেছে। সড়ক নিচু আর ড্রেন হয়ে গেছে উঁচু। তাই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপায় না পেয়ে ব্যবসায়ীরা যে যার মতো পানি পরিস্কার করছেন।’
শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের ভেতর দিয়ে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নামে দুটি নদ-নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভৈরব নদ দিয়ে শহরের উত্তরাংশ ও মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে শহরের দক্ষিণাংশের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু গত দেড় দশকে শহরের দক্ষিণাংশের পানি মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে নামতে পারছে না। পয়োনিষ্কাশন নালার মাধ্যমে শহরের পানি হরিণার বিল দিয়ে মুক্তেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু ২০১০ সালে হরিণার বিলে যশোর মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। এরপর আশপাশে আরও অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এতে বিল দিয়ে পানি আগের মতো নিষ্কাশিত হতে পারছে না। ওই পানি বের করার জন্য খালের মাধ্যমে মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু পৌরসভা গত দেড় দশকেও সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি।
যশোর পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী বিএম কালাম আহমেদ জানান, শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা কর্মতৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। শংকরপুর, মেডিকেল কলেজ এলাকা, চাঁচড়া, খড়কি পীরবাড়ি এলাকায় স্কেভেটর দিয়ে পানি দ্রম্নত নিস্কাশনের পদড়্গপে নেওয়া হয়েছে। দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পানি নিস্কাশনের জন্য সব ধরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।