মনিরুজ্জামান মনির : ফল বলতেই আপেল, আঙ্গুর, কমলাসহ আমদানি করা রকমারী ফলকে চিনে আসছে এদেশের মানুষ। সময়ের বিবর্তনে জনপ্রিয় ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফলের জায়গা দখল করেছে দেশি পেয়ারা।
কম দামে পাওয়া সুস্বাদু পেয়ারা এখন আর গরিবের ফল নেই। সব ঘরেই এখন পেয়ারার কদর। অনুষ্ঠান আয়োজনে ফলের তালিকায় পেয়ারার নাম অনেকটা আবশ্যক হয়ে গেছে। এমনকি রোগীর পথ্য হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে পেয়ারা।
যশোরের সবখানে চাষ হচ্ছে পেয়ারা। বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষে এসেছে নানা জাত। কৃষি গবেষকদের বদৌলতে উৎপাদিত হচ্ছে বীজমুক্ত পেয়ারাও। তবে যশোরের বাজারে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ পেয়ারা চৌগাছার বলে পরিচয় দেয়া হয়।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে চৌগাছা উপজেলায় ৬২০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হচ্ছে।
যশোর সদরের নলিতাদাহ গ্রামের পেয়ারা চাষি আবুল বাসার জানান, ‘আমি আগে ব্যবসা করতাম। বর্তমানে ৫ বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ করছি। মিশরি ফাইভ, তেলা ফাইভ এবং সেভেন জাতের পেয়ারা আছে আমার বাগানে। গাছের বয়স মাত্র আড়াই বছর। ভালো পরিচর্যা করলে চারা লাগানোর ৫-৭ মাসেই ফল বিক্রি করা সম্ভব।’
এই চাষি আরো বলেন, ‘পেয়ারা গাছ সাধারণত ৪-৫ বছর পর্যšত্ম ভালো থাকে। প্রথম পর্যায়ে চাষ ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। যার কারণে লাভে আসতে সময় লাগছে। তবে চলতি মৌসুমে ভালো লাভে আছি। তিন-চার মাসের মধ্যে বিক্রি করেছি আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা। চাষে খরচ আছে ৮০ হাজার টাকা মতো। ড়্গতে থেকে প্রতিকেজি পেয়ারা বিক্রি করি ৪০-৪২ টাকা দরে।
প্রতিদিন পাইকাররা বাগান থেকে পেয়ারা কিনে নিয়ে যায়। বড় কোন বাজারে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অর্ডারের মাল দিয়ে শেষ করতে পারি না। তবে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ পেলে আরো আগেই পেয়ারা চাষে সফল হতে পারতাম।’
লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষি সাগর হোসেন জানান, ‘২৬ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে বিভিন্ন ফল চাষ করছি। এর মধ্যে শুধু ১৫ বিঘা জমিতে পেয়ারা রয়েছে । আমার বন্ধু বাবু এবং আমি লেখাপড়া শেষ করে ফলের চাষ শুরম্ন করি।
৩ বছর আগে স্থানীয় মানুষ আমাদের বলতো শহরের পাগল। এখন সেই মানুষগুলো পেয়ারা দেখে বলে অনেক সুন্দর কিছু করেছেন। কিন্তু এ বছর আমরা পেয়ারা এবং আপেল কুলে সফল হয়েছি। ক্ষেতে নিয়মিত ১০ জন শ্রমিক কাজ করে। কৃষি বিভাগ থেকে একটু সহযোগিতা পেলে পেয়ারার চাষ আরো বৃদ্ধি করতে পারবো।’
রানিয়ালী গ্রামের পেয়ারা চাষি দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘৪ বছর আগে ২ বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ করি। ৩ বছর ধরে বিক্রি করে যাচ্ছি। চলতি ৩-৪ মাসে ১ লাখ টাকা মতো বিক্রি হয়ে গেছে। ৫০-৬০ হাজার মত লাভ হয়েছে। প্রতিকেজি পেয়ারা পাইকারিভাবে বিক্রি করেছি ৪০ থেকে ৪২ টাকা করে। নতুন করে এ বছর আরো ১ বিঘা জমিতে পেয়ারার চাষ শুরম্ন করবো।’
চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেন বিশ্বাস বলেন, পেয়ারার চাষ করে কৃষক এখন সফল। বর্তমানে এ এলাকার চাষিরা পেয়ারা চাষে ঝুঁকে পড়ছে। চাষ পদ্ধতিও অনেক সহজ । পেয়ারা মারবেলের মত হলেই পলিথিনের কাগজ দিয়ে মুড়ানো হয়। যে কারণে পোকা এবং বিষক্রিয়া একদম থাকে না। আমরা কুষ্টিয়া এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পেয়ারার নতুন নতুন জাত আমদানি করি এবং তা কৃষকদের মাঝে দিয়ে থাকি। বিভিন্ন সময় পেয়ারা চাষিদের প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিড়্গণ দিয়ে থাকি। তাদের পাশে আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা সবসময় থাকেন।
দেশি ফল বলে দাম কিছু কম হলেও পুষ্টিমানের দিক থেকে পেয়ারা মোটেও ফেলনা না।’
পুষ্টিবিদ আরিফ ইকবাল জানান, পেয়ারায় আঁশের পরিমাণ অনেক বেশি এবং ক্যালরির পরিমাণ কম। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের জন্য ভালো কার্যকারী। খোসাযুক্ত ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।
পেয়ারা আমাদের শরীরের জন্য ভিটামিন-সি চাহিদা পূরণে সহায়তা এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শ্বাসতন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখে এবং অ্যাজমা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এছাড়া গঠনগত উপাদানের বিবেচনায় আপেলের তুলনায় পেয়ারা বেশি উপকারী।
প্রতি ১শ গ্রাম পেয়ারায় ক্যালরি ৬৮, আপেলে ৫২, পেয়ারায় ফ্যাট ০.৪ গ্রাম, আপেলে ০.২ গ্রাম, পেয়ারায় কার্বোহাইড্রেট ১৪ গ্রাম, আপেলে ১৪ গ্রাম, পেয়ারায় প্রোটিন ২.৬ গ্রাম, আপেলে ০.৩ গ্রাম, পেয়ারায় ডায়েটারি
ফাইবার ৫ গ্রাম, আপেলে ২.৪ গ্রাম, পেয়ারায় চিনি ৯ গ্রাম আপেলে ১০ গ্রাম, পেয়ারায় ভিটামিন- এ ৬২৪ আইইউ, আপেলে ৫৪ আইইউ, পেয়ারায় ভিটামিন সি ২৮.৩ মিলিগ্রাম, আপেলে ৪.৬ মিলিগ্রাম, পেয়ারায় আয়রন ০.৩ মিলিগ্রাম, আপেলে ০.১ মিলিগ্রাম, পেয়ারায় পটাশিয়াম ৪১৭ মিলিগ্রাম, আপেলে ১০৭ মিলিগ্রাম, পেয়ারায় ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম এবং আপেলে ৬ মিলিগ্রাম।
পুষ্টিবিদরা বলছেন প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটি বা দুটি পেয়ারা রাখা হলে আমাদের শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ফলের দোকানগুলোতে বিদেশি ফলের পাশাপাশি পেয়ারাও স্থান পেয়েছে। তবে ক্রেতারা ভ্রাম্যমাণ ফল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই পেয়ারা কিনছেন বেশি।
যশোর দড়াটানার ফল বিক্রেতা অলিয়ার রহমান জানান, ১২ মাসই পেয়ারার ব্যবসা চলে। বর্তমানে আপেল, আঙ্গুর, বেদানা বা আনার এবং মালটার দাম বেশি হওয়ার কারণে পেয়ারার চাহিদা অনেক বেশি। প্রতিকেজি পেয়ারা ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি করি। প্রতিদিন দোকানে একশ কেজি পেয়ারা বিক্রি হয়।
ভ্যানে পেয়ারা বিক্রেতা রাজু আহম্মেদ জানান, ‘দিনে ৫০ কেজি মতো পেয়ারা বিক্রি করি। প্রতিকেজি ৫০-৫৫ টাকা দরে বিক্রি করে থাকি। প্রায় ৪ বছর এ ব্যবসা করে যাচ্ছি। এ ব্যবসা করেই আমার সংসার চলে।’
বাইসাইকেলে করে পেয়ারা বিক্রি করেন কামাল হোসেন। তিনি জানান, ঝিকরগাছা থেকে এসে ৪০-৫০ কেজি পেয়ারা বিক্রি করি । সাধারণত প্রতিকেজি পেয়ারা ৫০-৬০ টাকা করে বেচা হয়। দিন শেষে ৫-৭শ টাকা লাভ থাকে। বারো মাস এ ব্যবসা করে মোটামুটি সংসার চলে যায়।