সমাজের কথা ডেস্ক : পাগলা মসজিদের ৯টি দানবাক্সে পাওয়া গেছে ২৭ বস্তা টাকা। শনিবার (২০ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে দানবাক্সগুলো খোলা হয়। ২৭ বস্তায় রাত ৮টা পর্যন্ত ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা গণনা শেষে ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি কিশোরগঞ্জের ডিসি আবুল কালাম আজাদ খবরের কাগজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মোট ২২০ জন ব্যক্তি শনিবার দিনভর এই গণনাকাজে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ-আনসারের সদস্য, ব্যাংক কর্মী, মাদ্রাসাছাত্র এবং পাগলা মসজিদের স্টাফ।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দান সিন্দুকগুলো যেন টাকার খনি। দান সিন্দুকগুলো খুললেই পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা। এই দানের টাকায় নির্মিত হবে এশিয়ার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এবার পাগলা মসজিদের দানবাক্স ৪ মাস ১০ দিন পর খোলা হয়েছে। তিন মাস পরপর খোলার নিয়ম। এবার রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কিছুটা দেরিতেই খোলা হয়। করোনার সময়েও চার মাস পরপর খোলা হতো।
পাগলা মসজিদের দানবাক্স খোলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে মসজিদের ৯টি লোহার দান সিন্দুক খোলা হয়। এরপর ২৭টি সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে টাকাগুলো মসজিদের দোতলায় নেওয়া হয় গণনার জন্য। ১০২ জন মাদ্রাসার ছাত্র, রূপালি ব্যাংকের ৭০ জন কর্মকর্তা, পাগলা মসজিদের ৩৬ জন প্রশাসনিক স্টাফ ও ১০ জন আনসার ও ১০ জন পুলিশ সদস্যকে নিয়ে গণনার কাজটি করা হয়।
২০২৩ সালে মোট চারবার খোলা হয়েছিল পাগলা মসজিদের দানবাক্স। চারবারে মোট ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৮১ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিদিন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, দুধ-ডিমসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র মসজিদে মানুষ দান করেন। দানকৃত এসব জিনিস প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি করে থাকেন মসজিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর খোলা হয়েছিল দান সিন্দুকগুলো। তখন ৯টি দান সিন্দুক থেকে পাওয়া গিয়েছিল ২৩ বস্তা টাকা। এরপর রেকর্ড ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। টাকার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা, হীরা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকারও পাওয়া গিয়েছিল।
পাগলা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, ‘পাগলা মসজিদে মানুষ ধর্মীয় অনুভূতি থেকে দান করে থাকেন। আমরা পাগলা মসজিদটিকে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। পাগলা মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। যেই কমপ্লেক্সটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত হবে। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা থাকবে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২৫ কোটি টাকা। যেখানে একসঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। এ ছাড়া মসজিদটিতে পাঁচ হাজার নারীর জন্য নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে।’
পাগলা মসজিদের টাকার নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, ‘পাগলা মসজিদের টাকাটা মানুষের দানের টাকা। এই টাকাগুলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব জেলা পুলিশের ওপর বর্তায়। আমরা পাগলা মসজিদের দানের টাকার নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করি। এই টাকা সাধারণ মানুষের দান। শুধু লোহার সিন্দুক খোলার সময়ই না, সারা বছরই জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি টিম এখানকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।’
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে পাওয়া টাকা ও জমাকৃত টাকায় মসজিদ নির্মাণের কাজ সম্পর্কে পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘৪ মাস ১০ দিন পর ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দান সিন্দুক থেকে ২৭ বস্তা টাকা পাওয়া গেছে। মসজিদের প্রতি এই অঞ্চলের মানুষসহ সারা দেশের মুসল্লিরা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসল্লিদের অন্য ধরনের একটা আবেগ রয়েছে।
এই কিশোরগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে এসে দান করেন। অনলাইনে বা বিকাশে টাকা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে ৯টি দানবাক্স আছে, সেখানে তারা সরাসরি টাকা দান করে থাকেন। এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি যে এখানে বড় একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ হবে। অন্তত ৩০ হাজার মানুষ যেন এখানে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। আমাদের এই কাজের জন্য আগামী মাসেই পরামর্শক নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। এরপর মসজিদের মূল যে ডিজাইন, সেই ডিজাইনের কাজে আমরা হাত দেব। এ ব্যাপারে আমাদের সবারই আন্তরিকতা রয়েছে।
যত দ্রুত সম্ভব আমাদের মসজিদের কাজটি শুরু করা প্রয়োজন। দানবাক্সে যে পরিমাণ টাকা আসে, সব টাকা ব্যাংকে জমা রয়েছে। প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব রয়েছে। জমাকৃত অর্থের যে পরিমাণ লভ্যাংশ আসে, তা দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষদের চিকিৎসা খাতে ব্যয় করা হয়।’
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিত হন এবং তাকে ঘিরে আশপাশে অনেক ভক্তকুল সমবেত হতেন। সেই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে পরবর্তীকালে এই মসজিদটি গড়ে তোলা হয়। কালক্রমে এটি পাগলা মসজিদ নামে পরিচিত হয়। মসজিদটি শুধু মুসলিমদের কাছেই নয়, সব ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছেই অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। মানুষের বিশ্বাস, কেউ সহি নিয়তে এ মসজিদে দান-খয়রাত করলে তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়।