নিজস্ব প্রতিবেদক : সবজি, ফুল আর মাছের জেলা যশোরের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করেছে পদ্মাসেতু। ‘পদ্মার এপার-আর পদ্মার ওপার’-দেশের এই বিভক্তি দূর করে দেয়া পদ্মাসেতু হাসি ফুটিয়েছে কৃষক আর মৎস্যচাষীদের মুখে। পদ্মার ফেরি সময় লুটে নিয়ে প্রতিনিয়ত যে দুর্ভোগের জন্ম দিয়েছিল-তা মুছে দিয়েছে পদ্মাসেতু। এখন আর ফেরিঘাটে সবজি, ফুল আর রেণুপোনা পচে-মরে একাকার হয় না। লোকসান হয় না কোটি কোটি টাকার পণ্যের। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের একবছরে এই চিত্র সবজি, ফুল আর মৎস্য সেক্টরের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর জেলায় সারা বছর সবজির আবাদ হয়ে থাকে। বছরে ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষিরা বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করে থাকেন। যা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় আট লাখ টন সবজি। এসব সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে পাঠানো হয়। সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নে এই অঞ্চলের বৃহৎ পাইকারি সবজির মোকাম বারিনগর সাতমাইল সবজির হাট। এই হাটে যশোর সদর, চৌগাছা, পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের কৃষকদের উৎপাদিত সবজি পাইকারি বিক্রি করেন। এই বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৮শ’ থেকে ৯শ’ টন সবজি পাইকারদের মাধ্যমে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে।
বারীনগর হাটের ইজারাদার আবদুস সোবহান জানান, আগে দূরদূরান্ত থেকে ব্যাপারিরা তেমন আসতেন না। কিন্তু এখন ঢাকার পাশাপাশি সিলেট চট্টগ্রামের ব্যাপারিরাও আসছেন। অল্প সময়ের মধ্যে সবজি কিনে আবার তারা ফিরেও যাচ্ছেন। আগে এই সবজি নিয়ে ফেরিতে পদ্মা পার হতে ৭ থেকে ১২ ঘণ্টা কখনও কখনও তারও বেশি সময় লাগতো।
এখন পদ্মাসেতু হওয়ায় ৩-৪ ঘন্টায় তারা ঢাকা চলে যাচ্ছে। সিলেট চট্টগ্রামেও সবজি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান,আগে সবজি বিক্রি হবে কিনা; এমন পরিস্থিতি সবজির দাম পেত না কৃষকরা। কিন্তু এখন সবজির এই দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতু হওয়াতে ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রামের পাইকাররা এখন এই মোকামে আসছেন সবজি কিনতে। বাইরের জেলার পাইকাররা আসাতে স্থানীয় পাইকারদের সিন্ডিকেটে ভেঙ্গে কৃষকদের উৎপাদিত সবজি ন্যায্যমূল্যে দিয়েই কিনছে তারা। ফলে কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন।
হাটের ইজারাদার ও সবজির ব্যাপারীরা বলছেন, পাঁচ টনের এক ট্রাক সবজি যশোর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে নিতে আগে ট্রাকভাড়া লাগতো ২৫ হাজার টাকা। এখন পথ কমায় ১৭ থেকে ২০ হাজার মধ্যে ভাড়ায় হয়ে যাচ্ছে। সময় কমে যাওয়ায় সবজি পঁচে যাওয়া বা ঘাটের দেরিতে ঢাকার জ্যামে পড়ে শহরের ঢুকতে বিড়ম্বনা কমে গেছে। পদ্মাসেতু সবজি চাষীদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে।
সবজি জোন যশোর সদরের হৈবতপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম চলতি মৌসুমে দেড় একর জমিতে করলা, দুই বিঘা জমিতে পটল চাষ করেছেন। ক্ষেত থেকে পটল আর করলা তুলে সাতমাইল বারিনগরে বিক্রি করতে এসেছিলেন। হাটে সবজি নিয়ে যেতেই পাইকারদের কাছে ন্যায্যমূল্যে সবজি বিক্রি করতে পেরে বেজায় খুশি তিনি। জানালেন, প্রায় ৩০ বছর সবজি চাষ করেন। হাটে পাইকারি দরে প্রতি কেজি পটল ৩৭ টাকা, করলা ৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। বললেন, ‘এই সময়ে সবজির এমন দাম পাবো ভাবেনি। গত বছর এই সময়ে পটল ১০ থেকে ১৫ টাকায়; আর করলা ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছিলাম।’
সবজির মতো ফুলও পদ্মাসেতুর কল্যাণে ছুটছে দেশের নানাপ্রান্তে। তিন ঘণ্টায় পদ্মা পেরিয়ে যাওয়ায় ফুল নষ্ট বা বাজার ধরতে না পারার আক্ষেপ ঘুচেছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর ফুলচাষিরা বাণিজ্যিক ফুল চাষের গোড়াপত্তন করেছে। এ উপজেলার প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, লিলিয়ামসহ ৭২ ধরনের ফুলের চাষ হয়। বছরে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ফুল যশোর থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে প্রধান ভূমিকা রাখে পরিবহণ। আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে এক সময় ফেরিঘাটে ফুলের মান নষ্ট হয়ে যেতো। ১০/১২ ঘণ্টা আটকে থেকে ফুল যেমন নষ্ট হতো, তেমনি সময়মত ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে না পেরে বাজার হারাতে হতো। এখন গদখালির ফুল তিন থেকে চার ঘন্টায় ঢাকা শহরে চলে যাচ্ছে। ফুল ব্যবসায়ীরা সরাসরি গাড়ি নিয়ে গদখালিতে আসছেন। তাদের পছন্দমতো ফুল স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চাষীদের কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। পদ্মসেতু মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে দিয়েছে। ফলে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ ফিরোজ খান বলেন, মৎস্যপল্লী খ্যাত যশোরের চাঁচড়া ও আশপাশের এলাকার নার্সারিতে বছরে কয়েক লাখ টন রেণুপোনা উৎপাদন হয়। যা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ পূরণ করে। আগে ঢাকাসহ পদ্মার ওপারে রেণুপোনা পাঠাতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। ঘাটে জ্যামের কারণে ১০/১২ ঘণ্টা লেগে যেত। অনেক রেণু ও পোনা মারা যেতো। অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষতি হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আমরা ৩/৪ ঘণ্টার মধ্য ঢাকায় মাছ ও পোনা পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি। লোকসানের হার নেই বললেই চলে।