২৫শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর
নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর

মিলন রহমান : যশোরে নার্সারির গ্রাম বাসুদেবপুর থেকে বছরে প্রায় এক কোটি গাছের চারা ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। এই গ্রামের ঘরে ঘরেই নার্সারি। ছোট বড় প্রায় চারশ’ নার্সারিতে এমন কোনো চারা নেই যা পাওয়া যায়না। বছর জুড়ে সারাদেশে ট্রাক ভর্তি করে চারা সরবরাহ করেন নার্সারি মালিকরা। এতে একদিকে যেমন গ্রামজুড়ে সবাই স্বাবলম্বী হয়েছেন; তেমনি এই বিপুল পরিমাণ চারা উৎপাদন করে ভূমিকা রাখছেন পরিবেশ রক্ষায়।


যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের একটি গ্রাম বাসুদেবপুর। যশোর শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত গ্রামটিতে প্রায় ৫শ’ পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে চারশ’ বাড়িতেই আছে নার্সারি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক নার্সারি শতাধিক। আর বাসুদেবপুর বাজারে শতাধিক ছোট বড় চারা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন গ্রামের চারভাগের তিনভাগ বাসিন্দাই নার্সারির সঙ্গে জড়িত। গ্রামের যেদিকেই চোখ যায় শুধুই নার্সারি আর গাছের চারা। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা থেকে শুরু করে দেশি সবধরণের ফল ছাড়িয়ে আপেল, কমলালেবু, আঙুর, মাল্টা, বিদেশি পার্সিমন, ডরিয়ান, রামবুটান, পিনাক বাটার, কিউই, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দনসহ বিভিন্ন ফলদ ও ভেষজ গাছের চারা রয়েছে এই নার্সারিগুলোতে।


বাসুদেবপুরে নার্সারির গোড়াপত্তন করেন মোহাম্মদ আলী (৭২)। মণিরামপুর উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় তিনি ‘নার্সারির গুরু’ হিসেবেই পরিচিত। বাজারের পাশে ‘পুরাতন নার্সারি’ নামে তার প্রতিষ্ঠানটি এখন ছেলেরা দেখাশোনা করেন।


শুরুর কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী ফিরে যান প্রায় ৬০ বছর আগের অতীতে। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। বাবা ওলিউল্লাহ মুন্সীর সঙ্গে ঝিকরগাছা বাজারে যেতেন লিচুর কলমের চারা নিয়ে। এক, দু আনা দরে বিক্রি করতেন। সে সময় নৌকায় করে বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা ঝিকরগাছায় আসতেন আমড়া, তেজপাতা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছের চারা নিয়ে। তাদের চারা পর্যবেক্ষণ ও আলাপ আলোচনা করে ধীরে ধীরে শেখার চেষ্টা করেন অন্যগাছের চারা তৈরির পদ্ধতি। লিচুর পরে সুপারির চারা করতেন। পরে জামরুল, তেজপাতা, সফেদা, আম, কুল, পেয়ারা ইত্যাদির চারা ও কলম তৈরি শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৫৫ বছর ধরে তিনি নার্সারিতে চারা উৎপাদন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা দেশে।


মোহাম্মদ আলী আরও জানান, তার বাবা নার্সারির ব্যবসা শুরু করলেও প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন তিনি। এখন এই গ্রামে অত্যন্ত ভালো মানের চারা তৈরি হয়। অন্য এলাকার তুলনায় দামেও কম। যে কারণে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ সারাদেশের পাইকারি বিক্রেতা ও কৃষি উদ্যোক্তারা এখান থেকে চারা কিনে নিয়ে যান। মোহাম্মদ আলী চারা তৈরি ও ব্যবসা করে ২৫ বিঘা জমি কিনেছেন। পাকা বসতবাড়ি বানিয়েছেন।


এখন ‘পুরাতন নার্সারি’র একাংশ দেখাশোনা করেন মোহাম্মদ আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাবার হাত ধরেই তিনি নার্সারি ব্যবসায় এসেছেন। তাদের নার্সারি থেকেই বছরে কয়েক লাখ গাছের চারা সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি গ্রামের ঘরে ঘরে এখন নার্সারি। সারাবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা গাছের চারা সরবরাহ করেন। গ্রামের চার শতাধিক নার্সারি থেকে সারাবছর যে চারা সরবরাহ করা হয় তার সংখ্যা কোটি স্পর্শ করবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এবছর উত্তরবঙ্গ থেকে যে পরিমাণ লিচুর চারার অর্ডার রয়েছে তার দামই দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। আসন্ন মৌসুমে এই চারা সরবরাহ করা হবে।


আকাশ নার্সারির স্বত্বাধিকারী শাহজাহান কবীর জানান, বাবার হাত থেকে ১৮ বছর আগে তিনি নার্সারির কাজে হাত দেন। তিনি বলেন, তার নার্সারিতে দশজন শ্রমিক কাজ করে। নার্সারিতে তিনি আম, আমড়া, পেয়ারা, কমলালেবু, মাল্টা, মিষ্টি তেতুল, জলপাইসহ ফলদ, বনজ ও ঔষধি বিভিন্ন গাছের চারা উৎপাদন করেন। বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা গাড়িভরে এসব চারা কিনে নিয়ে যায়। বছরে তিনি প্রায় ৫০ হাজার চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকেন।


নার্সারি শ্রমিকের কাজ করা ভোলানাথ সরকার ও শহিদুল ইসলাম মনু জানান, গ্রামের ঘরে ঘরে নার্সারি হওয়ার পর এখন আর কাজের অভাব হয় না। গ্রামের শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ নার্সারিতে কাজ করেন এবং যে বেতন পান তাতে সংসার চলে যায়।
গ্রামে নার্সারির প্রসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাল হোসেন বাড়ির উঠানে ও ছাদে নার্সারি করেছেন তিনবছর হলো। তিনি জানালেন, বাড়ির ছাদে ও উঠানে তার ৬০ রকমের গাছের চারা রয়েছে। গত বছর তিনি চারা বিক্রি করে তিন লক্ষাধিক টাকা আয় করেছেন।


এ ব্যাপারে মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকা বলেন, রোহিতা ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরেই নার্সারি। তারা অনেক ধরণের গাছের চারা উৎপাদন এবং বছর জুড়ে সারাদেশে সরবরাহ করে থাকেন। বিশেষ করে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন জাতের চারা তৈরি করে সরবরাহ করেন। এই নার্সারির মাধ্যমে গোটা গ্রামের মানুষ যেমন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন; তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে; তেমনি লাখ লাখ গাছের চারা উৎপাদন করে তারা পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram