নয়ন খন্দকার, কালীগঞ্জ : সাবিনা ইয়াসমিন ও তুলি বেগম দুজনেই গৃহবধূ। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ঘরের বারান্দায় বসে একসাথে হাতে তৈরি করছেন শোলার তৈরি শাপলা, লিলি, চন্দ্রমলি¬কা, বেলি, গোলাপসহ নানা প্রকারের ফুল। ঘর গৃহস্থলীর কাজ সেরে প্রতিদিন তারা এই ফুল তৈরির কাজ করে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। তাদের মতো ওই গ্রামের আরো প্রায় ৩০ জন মহিলা শোলার ফুল তৈরি করে আয় করছেন।
গ্রামীণ গৃহবধূদের শোলার ফুল তৈরির প্রতিদিনের এ দৃশ্য দেখা মিলবে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের নরদহী গ্রামের মাঝের পাড়ায়। ২০০১ সালে প্রথম এই গ্রামের মহিলারা শোলার ফুল তৈরি কাজ শুরু করেন। নদী—নালা, খাল—বিলে জন্মানো সোলা গাছ এই ফুল তৈরির প্রধান উপকরণ। শুকনো শোলা পরিমাপ মত কেটে রোল তৈরি করে ফুলের মাপ অনুযায়ী তা কেটে নিতে হয়। এরপর হাতের সাহায্যে সুতা দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন প্রকার ফুল তৈরি করতে হয়। আর গ্রামীণ নারীদের সুনিপুণ হাতে প্রতিনিয়তই আমাদের অতি পরিচিত বেলি, জিনিয়া, গোলাপ, চামেলি, পদ্ম, রজনী কলি, শাপলাসহ প্রায় ৪০ প্রকার ফুল তৈরি হচ্ছে।
নারীদের তৈরিকৃত শোলার ফুল ‘রিগ্যাল হ্যান্ডিক্রাফট এন্ড ড্রাই ফ্লাওয়ার’ নামে করা হচ্ছে বাজারজাত। শোলার তৈরি সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন বেলি, গোলাপ, চামেলি, লিলি, চন্দ্র মলি¬কা ও শাপলা ফুল যথাক্রমে হাজার প্রতি ১২০০, ১৩০০, ১৮০০, ১৬০০,২০০০ ও ২৫০০ টাকায় শুধুমাত্র ঢাকা শহরের নিউমার্কেট কলাবাগান ও মিরপুরে বিক্রি হয়।
বর্তমানে কাঁচামালের অভাব, পর্যাপ্ত পুঁজি বিনিয়োগ করতে না পারা, নতুন নতুন ক্রেতা সৃষ্টি করতে না পারা, কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব, প্রস্তুতকৃত মাল সংরক্ষণের স্থানের অভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় শোলার ফুল প্রস্তুতকারী নারীদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি আজও।
শোলার ফুল তৈরির কাজ করা গৃহবধূ ইয়াসমিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে আওতায় যদি আমাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো তাহলে আমাদের গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামের নারীরা শোলার ফুল তৈরির মধ্য দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারতো। বর্তমানে আগের মত আমাদের প্রতিদিন কাজ হয় না, ফলে আয় ও কমে গেছে। তাই আমরা শোলার ফুল শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
শোলার ফুল তৈরি ও বিপণনের সার্বিক দায়িত্ব পালনকারী তোফায়েল আহমেদ জানান, বর্তমানে স্থানীয়ভাবে ফুল তৈরির মূল উপকরণ শোলা পাওয়া না যাওয়ায় খুলনা ফরিদপুর ও মাগুরা থেকে বেশি দামের শোলা ক্রয় করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে আমি হিমশিম খাচ্ছি।
ব্যাংক থেকে ঋণ সহায়তাও পাচ্ছি না। চাহিদা থাকার পরেও বর্তমানে এ ব্যবসায় বেশ মন্দা যাচ্ছে। মাসে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করে খরচ বাদে মাত্র ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকছে। সরকারি সহায়তা পেলে শোলার শিল্পকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
রাখালগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম মন্টু বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে আমার ইউনিয়নের নরদহী গ্রামের নারীরা শোলার ফুল তৈরির কাজের সাথে যুক্ত। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কাছে তাদের দূরবস্থার চিত্র তুলে ধরায় তিনি মাঝারি আকৃতির একটি দোচালা ঘর নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। যেখানে তারা একসাথে বসে সহজেই ফুল তৈরির কাজ করতে পারবেন।
শোলার তৈরি ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে এই ফুল তৈরি করে তা বিপণন করতে পারলে আমার ইউনিয়নের নারীরা একদিকে যেমন উপকৃত হবেন অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে বলে আমি মনে করি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী বিনিয়োাগকারী বন্ধুদের শোলার তৈরি ফুল তৈরি শিল্পের দিকে সুদৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।