সমাজের কথা ডেস্ক : প্রায় আড়াই বছর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম মস্কো যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণেই তার দুই দিনের এই সফর (৮ ও ৯ জুলাই)। যেখানে দুই নেতার মধ্যে একান্ত বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে। সারা বিশ্বের কূটনৈতিক মহলও এই সফরের দিকে সতর্ক নজর রাখছে।
ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী মোদি যেমন সোমবার মস্কোর উদ্দেশে রওনা হবেন, ঠিক একই দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চীন সফরের জন্য বেজিংয়ের পথে রওনা দেবেন। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দুই নেতার এই দুটি সফরেরই গুরুত্ব অপরিসীম।
নরেন্দ্র মোদি যখন মস্কো অবস্থান করবেন, ঠিক তখনই ওয়াশিংটনে শুরু হবে পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোর বৈঠক (৯-১১ জুলাই)। নেটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, চলমান সংঘাতে ইউক্রেনকে ‘সাহায্য অব্যাহত রাখাটা’ হবে তাদের বৈঠকের সবচেয়ে জরুরি এজেন্ডা। নেটোর সদস্য দেশগুলো যে মোদির রাশিয়া সফরের পরিণতির দিকে তাকিয়ে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে ভারতের অবস্থান খুবই ‘ইউনিক’ বা অনন্য – কারণ তারা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে এখনও অবধি একবারের জন্যও সরাসরি অভিযুক্ত করেনি বা জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটও দেয়নি। আবার পশ্চিমা দেশগুলো যখন একজোট হয়ে পুতিনকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে, তখন দিল্লি মস্কোর সঙ্গে শুধু ঘনিষ্ঠতাই বাড়ায়নি – পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বা পাশ কাটিয়ে রাশিয়া থেকে শস্তায় বিপুল পরিমাণ তেলও কিনে চলেছে। রাশিয়া-ভারত বাণিজ্যের পরিমাণও দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যদিকে এই একই সময়কালে ভারতের সঙ্গে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠতাও বহুগুণ বেড়েছে। চীনবিরোধী বলে দেখা হয় যে জোটকে, সেই ‘কোয়াডে’র সদস্য হিসেবে ভারত শুধু আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারেই পরিণত হয়নি, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সামরিক সহযোগিতাও অনেক বেড়েছে। এমনকি, আক্রান্ত দেশ ইউক্রেনের সঙ্গেও ভারত এখনও রীতিমতো সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে, সেখানে ত্রাণও পাঠিয়েছে।
এই দুটোর মধ্যে অনেকেই একটা ‘স্ববিরোধিতা’ দেখছেন। কিন্তু তার পরেও ভারত যুদ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে (রাশিয়া বনাম পশ্চিম) একটা ভারসাম্য বিধান করেই এতদিন চলেছে।
সম্ভবত সেই ধারাবাহিকতাতেই ভারতও নরেন্দ্র মোদির সফরের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যটাকে কিছুটা খাটো করে দেখিয়ে এটিকে মূলত ‘দ্বিপক্ষীয় সফর’ হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছে। অর্থাৎ তারা বলতে চাইছে, এই সফর সবার আগে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যেকার নিজস্ব কূটনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা যেমন বলেছেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই রুশ-ভারত সম্পর্ক একটা অন্য উচ্চতায় গেছে এবং দুই দেশ স্থির করেছে তাদের নেতারা প্রতি বছরই শীর্ষ সম্মেলনে (সামিট) মিলিত হবেন। পালা করে এক বছর সেই সামিট ভারতে ও পরের বছর রাশিয়ায় হবে। সে অনুযায়ী শেষ সামিট হয়েছিল ২০২১-এ, যখন প্রেসিডেন্ট পুতিন দিল্লিতে এসেছিলেন। ফলে এবার মোদির মস্কো যাওয়ার পালা। কিন্তু নানা কারণে সেই সফর এতদিন হয়ে উঠতে পারেনি, যা অবশেষে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
রাশিয়া এই মুহূর্তে ভারতের কাছে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় সস্তা দরেই তেল বিক্রি করছে, যা ব্যারেল প্রতি প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ ডলার কম। ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এই ‘ডিসকাউন্ট’ যাতে আরও বাড়ানো হয় এবং ভারত আরও সস্তায় রাশিয়ান তেল কিনতে পারে সে জন্য এই সফরে ভারতের তরফ থেকে অনুরোধ জানানো হবে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ভারত রাশিয়াতে ওষুধপত্র (ফার্মা), ভারি যন্ত্রপাতি (মেশিনারি) ও অন্যান্য পণ্য রফতানি করতে চাইবে।
মস্কোভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট আলেক্সেই জাখারভ মনে করেন, মোদির এই সফরকে রাশিয়াও তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার সব রকম চেষ্টা করবে।
তিনি বলছিলেন, ‘একদিকে যখন ওয়াশিংটনে নেটোর সামিট চলবে, তখনই মস্কোতে ভারতের মতো একটি দেশ, যারা পশ্চিমাদেরও গুরুত্বপূর্ণ শরিক, তার নেতাকে হোস্ট করে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ছবিটাকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার চেষ্টা হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দেখানো যাবে যে পুতিন আদৌ কোণঠাসা নন, বরং পশ্চিমাদের বন্ধুরাও তাকে কদর করছেন এবং মর্যাদা দিচ্ছেন।’
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক ওআরএফের (অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন) গবেষক নন্দন উন্নিকৃষ্ণন আবার এই সফরকে দেখছেন একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে। তিনি মনে করেন, ‘আমেরিকাই হোক বা রাশিয়া- যে কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র, এই সফর তারই প্রমাণ।’
তিনি বলছিলেন, ‘নানা কারণে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্কও কিন্তু গত দু-তিন বছরে কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে। দুই নেতার মধ্যে মুখোমুখি দেখা হলে সেই সব অস্বস্তি ও সন্দেহ দূর করা সম্ভব হবে, দুই পুরনো মিত্রের মধ্যে আস্থা আরও বাড়বে। তা ছাড়া আমি নিশ্চিত ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়েও মোদি পুতিনের মুখ থেকে তার বক্তব্য শুনতে চাইবেন!’