মনিরুজ্জামান মনির : ৪ লাখ মানুষের যশোর শহরে পাবলিক টয়লেট (গণ-শৌচাগার) মাত্র ১০টি। এরমধ্যে ৮টির অবস্থাই শোচনীয়। দুর্গন্ধ, নোংরা পরিবেশ, ভাঙ্গা দরজা, নেই পানির ব্যবস্থা। এ অবস্থায় প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসা, নানা কাজে গ্রাম থেকে শহরে আসা ও ভাসমান মানুষদের দুর্ভোগের ভাষা বর্ণনার বাইরে। বিশেষ করে নারীরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন।
যশোর পৌরসভা তথ্য মতে, পৌরসভায় মোট ১০টি গণ শৌচাগার রয়েছে। এগুলো হচ্ছে চাঁচড়া চেকপোস্ট, গোহাটা সড়ক, মাছ বাজার, পৌর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, পালবাড়ী বাজার, যশোর জেনারেল হাসপাতাল, যশোর ইনিস্টিটিউট, কালেক্টরেট, পৌরপার্ক এবং খুলনা বাসস্টান্ড। এর মধ্যে ইজারা দেওয়া আছে মাত্র ৪টি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের গণ-শৌচাগারের মধ্যে মাত্র দুইটি চলন সই। বাকীগুলোর সমস্যা প্রকট। পুরতান বাসস্ট্যান্ডের গণ-শৌচাগার সংস্কারের নামে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। টাউন হল মাঠের গণ-শৌচাগার খোলা হয় অনুষ্ঠানের দিনে। অন্য দিনগুলোতে বন্ধ থাকায় প্রয়োজনীয় মানুষ শৌচাগারের বাইরেই কাজ সারে। ফলে খোলা থাকলেও বাইরের পরিবেশ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যায় না। আবার ভেতরে প্রবেশের পর পানির অভাবে নোংরা অবস্থায় বের হয়ে আসেন অনেকে।
এই শহরে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের পদচারণা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে নানা কাজে শহরে আসে মানুষ। অনেকে দিনের কাজ দিনে শেষ করে ফিরে যান বাড়িতে। কিন্তু এই ব্যস্ত শহরে ব্যস্ত মানুষের বাথরুমের বেগ আসতেই পারে। ঠিক এ সময় সমস্যায় পড়তে হয় অধিকাংশকেই । খুঁজে বেড়াতে হয় শৌচাগার। গণ-শৌচাগার পেলেও যাওয়ার পরিবেশ থাকে না সেগুলোর। এ অবস্থায় কেউ দায় ঠেকে ঐ পরিবেশেই টয়লেট ব্যবহার করেন আবার কেউবা একটু ভাল স্থানের সন্ধান করেন। তবে এ অবস্থায় খুব বিপাকে পড়েন নারীরা। পুরুষরা যেখানে সেখানে পরিবেশ নষ্ট করে কাজ সারতে পারলেও মহিলারা প্রস্রাব চেপে রাখতে বাধ্য হন। যাতে প্রকারন্তে তার শারীরিক ক্ষতিই হয়।
রাতের অন্ধকারে, আড়ালে আবডালে উন্মুক্ত স্থানে বাথরুমের প্রয়োজন মেটানোর প্রবণতা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু পরিবেশ সম্মত গণ-শৌচাগার না থাকায় প্রয়োজনে যেখানে সেখানেই চলছে প্রয়োজন মেটানোর কাজ। ফলে নোংরা হচ্ছে শহর। তবে খেলা স্থানে মল ত্যাগকারীর সংখ্যা অতি নগন্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর শহরের অধিকাংশ গণ শৌচাগারে রয়েছে নানা ধরনের সমস্যায়। খুলনা বাসস্টান্ড বা মনিহার রোডে গণ শৌচাগার রাস্তা সংস্কারের জন্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। খোলা স্থানে বাথরুম চালু করেছে মণিহার এলাকায় অবস্থান নেয়া মানুষরা। সেখানে যেখানে চোখ যায় সেখানেই অস্বাস্থকর পরিবেশ। যশোর বাস টার্মিনালের গণ শৌচাগারের অবস্থাও ভালো নেই। প্রায় দরজা গুলো ভাঙ্গা। নেই পানির কোন সু-ব্যবস্থা । বাথরুমের দেওয়াল এবং ভিতরে বসার স্থানও ভেঙ্গে গেছে।
চেকপোস্টের গণ শৌচাগারে টাইলস করা থাকলেও পানির কোন ব্যবস্থা নেই। ভেঙ্গে গেছে বাথরুমের দরজা এবং ভিতরের বাথরুমের বসার স্থান। এদিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের গণ শৌচাগারে বিকেল ৪টার পরে তালা পড়ে যায়। আবার যশোর বড়বাজারের গণ শৌচাগারের অবস্থাও খুবই খারাপ। ভেঙ্গে গেছে দরজা, শৌচাগারের পাশে খোলা স্থানে ময়লার স্তুপ। যশোরে ১০টি গণ শৌচাগারের মধ্যে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন রয়েছে যশোর পৌরপার্কেরটা। বাকি ৯টিতেই আছে বিভিন্ন সমস্যা।
চেকপোস্টের পরিচ্ছন্ন কর্মি প্রেম লাল জানান, আমরা প্রতি ব্যক্তির নিকট হতে প্র¯্রাবের জন্য ৫ টাকা এবং বাথরুম করলে ১০ টাকা নিয়ে থাকি। প্রতিদিন হিরোনকে ৩’শ টাকা করে দিতে হয়। তবে আমাদের কষ্ট হচ্ছে বাথরুমের পানি দুর থেকে নিয়ে আসতে হয়। ৬ মাস আগেও পানির ট্রাংকি বসানোর জন্য পৌরসভা থেকে দেখে গেছে। ভিতরের জায়গা অনেক কম। বাথরুমের প্যান ভাঙ্গার কথা বললেও এখনো ঠিক করে দেয়নি। আমি নিজেই সিমেন্ট দিয়ে কোন রকম ঠিক করে ব্যবহার করার উপযোগি করেছি।
মনিহার রোডে পান ও চা বিক্রেতা রুহুল আমিন জানান, এখানে বাথরুম ভাঙ্গার পরে সবারই সমস্যা হয়। বর্তমানে আমরা যেটায় যাই সেটা আগের নষ্ট পুরাতন বাথরুম। এই বাথরুম ব্যবহারের কোন পরিবেশ নেই।
বাসের স্টাফ আলিমুল জানান, ‘আমরা খুব কষ্টে আছি। রাত-দিন গাড়িতেই থাকি। কিন্তু যশোরে আসলে প্রসাব-পায়খানায় অনেক কষ্ট পায়। পানি নেই দরজা ভাঙ্গা এবং প্রচুর দুর্গন্ধ। বাথরুমে গেলে বমি চলে আসে।’
শাহনাজ বেগম নামে একজন জানান, ‘আমরা কয়েকজন মহিলা মণিহারের আসপাশেই বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকি। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে টার্মিনালের বাথরুম ব্যবহার করতাম। কিন্তু কয়েক মাস আগে রাস্তার কাজ করার জন্য নতুন বাথরুম ভেঙ্গে ফেলেছে। এ কারণে আগের সেই পুরাতন বাথরুম চালু করেছে। আর এ বাথরুমের অবস্থা আগেই তো খারাপ ছিলো যার কারণে নতুন করে করা হয়ে ছিলো।
বড়বাজারের মাছ ব্যবসায়ি শাহ আলম জানান, এখানকার টয়লেটের করুণ খুবই অবস্থা। যাওয়ার কোন পরিবেশই নেই। বাহির থেকে যা দেখছেন তার থেকে ভিতরের অবস্থা আরো খারাপ। তার পরেও বিকেল ৫টায় তালা দিয়ে চলে যায়। এর পর আমরা বাথরুম আসলে বেশির ভাগ সবাই মসজিদে যায়।
বড়বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আসরাফ জানান, ‘টয়লেটে যাওয়া কোন পরিবেশ নেই। তারপরও আমাদের যেতে হয়। বাহির থেকে আপনি নিজেই দেখুন। কি পরিবেশে আছে এখানকার টয়লেট। ’
যশোর পৌরসভার প্রশাসনিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুন্ডু বলেন, আগের চেয়ে যশোরের গণ শৌচাগার অনেক ভালো। ইজারা দেওয়া গুলোই তেমন সমস্যা নেই। তবে অন্য গুলোই একটু সমস্যা আছে। কিন্তু যে ৪টি ইজারা দেওয়া আছে সেগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। আর কয়েকটি আছে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের সময় খোলা হয়। অনুষ্ঠান শেষ হলে পরিষ্কার করে বন্ধ করে রাখা হয়। তবে এ বছর ৫টি শৌচাগার ইজারা দেওয়া হবে।
পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গনি খান পলাশ বলেন, মনিহারের পাশে গণ শৌচাগারটি রাস্তার কাজের জন্য ভাঙ্গা হয়েছে। এখানে খুব দ্রত নতুন টয়লেটের কাজ শুরু হবে। পৌর সভার ভিতরে যে গুলোর সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে গুলোর টেন্ডারের জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। পাস হয়ে গেলেই কয়েক মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে। গণ শৌচাগার এবার নতুন করে সংস্কার হবে।