দেশসহ বিশ্ববাসী সম্যক অবগত আছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিশপ্ত আর্তনাদ পুরো বিশ্বকেই কঠিন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে অতিবৃষ্টি—অনাবৃষ্টি—খরা—বন্যা—দাবদাহ ইত্যাদি সংকটে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব প্রচন্ড অনুভূত। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের অধিকমাত্রায় শিল্পায়ন—নগরায়ণ—পরিবহনসহ নানামুখী উৎপাদন ব্যবস্থায় জ্বালানি—সার—কীটনাশক—কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি ধরিত্রীর তাপমাত্রাকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে।
সামগ্রিক পরিবর্তনজনিত দৃশ্যপট বর্তমান—আগামী প্রজন্মের বসবাসযোগ্য পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে কোন্ অবস্থানে নিপতিত করছে তা এখনো যথার্থ অর্থে বোধগম্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলায় অনুন্নত—উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ—জনগণ বিভিন্ন সমস্যায় বিপন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
ক্ষুধা—দারিদ্র্য—মানবেতর জীবনপ্রবাহে এর গতিধারা খরস্রোতা নদীর মতো সুস্থ জীবনযাপনে নদী ভাঙনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলছে। নদীমাতৃক জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশ বায়ু—শব্দ—পরিবেশ দূষণে এর বৈরী দৃষ্টান্তের পরিচায়ক। কৃষি—শিল্প—আর্থ—সামাজিক ব্যবস্থার পর্যুদাস প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করছে। প্রায়োগিক কর্মকৌশল অবলম্বনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ উক্ত সমস্যাসমূহকে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।
জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলন ২০২৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলনে ‘ফ্রম পকেট টু প¬ানেট : স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মুখে ছয়টি প্রস্তাব পেশ করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন ছাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তহবিলকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার উদাত্ত আহ্বান ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
পরামর্শগুলোর উপস্থাপনে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঠিক পথে রাখতে জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুই বছরে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি মেনে চলতে হবে। এই বছরের শেষ নাগাদ আমাদের সকলকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে, বিশেষ করে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর ২০২৫ সাল পরবর্তী একটি নতুন জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে একমত হতে হবে।
বিশ্বকে যুদ্ধ—সংঘাত, অবৈধ দখলদারি এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী—শিশুদের নির্মম হত্যাকান্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। জলবায়ু প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করতে অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান পর্যায় অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী অভিযোজনে সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ইউরো প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দেওয়ায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ইতোমধ্যে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন প¬্যাটফর্ম (বিসিডিপি)’ নামে একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, যার আকার প্রায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তাছাড়া ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে ৫৫০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে, যার অর্ধেকই থাকছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়। উলে¬খ্য, ৮০০ কোটি ডলারের মধ্যে আইএমএফের অংশ হচ্ছে ১৪০ কোটি, বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি, এআইআইবির ৪০ কোটি, কোরীয় সরকারের ৪ কোটিসহ অন্য সংস্থাসমূহের কম—বেশি অর্থায়ন রয়েছে। মোদ্দাকথা, প্রধানমন্ত্রীর পরার্মশক্রমে অস্ত্র উৎপাদন—বিক্রয় এবং এর অপব্যবহারে অসম অস্ত্র প্রতিযোগিতায় গণহত্যা পরিহার করে শান্তিময় বিশ্ব স্থাপনের লক্ষ্যে বিশ্ব নেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ জরুরি।
আগামী দিনের বিশ্ববাসীকে সুস্থ—নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য জীবনপ্রবাহ নির্বাহে সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থের জোগান ও বিতরণকে অধিকমাত্রায় প্রাধান্য দেওয়াই হচ্ছে যুগের জোরালো দাবি।