১১ই ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নারীকথা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রথম পড়ে নারীর ওপর

বাসন্তী সাহা : বাংলাদেশের কয়রা, আশাশুনি, দেবহাটা, শ্যামনগরের নারীরা, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। নদীভাঙনে যারা হারিয়েছেন বাপ—দাদা, স্বামীর ভিটেমাটি। প্রতি বছর নদীভাঙনের কারণে ঘটিবাটি সংসার নিয়ে বার বার সরে যেতে হয় এক বাড়ির উঠোন থেকে আরেক বেড়িবাঁধে। বাড়ির কাছে নদী ছিল, সেখানে ছিল দুটি তেতুঁল আর একটি মিষ্টি আমের গাছ। পুকুরে মাছ ছিল, গরুগুলো তখনও মাঠে। সিডর, আইলা, আম্পানে হারিয়ে গেছে সবকিছু। এমন কাহিনি রাধা রানী, আয়না বিবি, বাসন্তি মুন্ডাদের।

বাসন্তি মুন্ডা (৩২)। বাড়ি কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা সদর ইউনিয়নে। শাখবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধের ওপরেই সংসার পেতেছেন। ২০০৯ সালে আইলায় নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে তার শ্বশুর—শাশুড়ি এখানে এসেছিলেন। স্বামী মাছ ও কাঁকড়া ধরেন। নিজে একসময় দর্জির কাজ করতেন। এখন বাচ্চা ছোট থাকার কারণে বাড়িতেই থাকছেন। বেড়িবাঁধের অবস্থাও ভালো না। বাঁধ কেটে জমিতে নোনাপানি ঢোকানোর ফলে বাঁধ নড়বড়ে হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে। শাশুড়ির কাছে শুনেছি নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে তারা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাও প্রায় ১৩ বছর হবে। আমরা বাঁধের ওপরেই পড়ে আছি। স্বামী নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে দিনমজুরি করে কোনো রকমে এই বেড়িবাঁধে মাথা গুঁজে আছি।' আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ ঘর পেয়েছেন, ফিরে গেছেন বাঁধের আশ্রয় থেকে। নতুন করে জীবন শুরু করেছেন কিন্তু বাসন্তি মুন্ডারা রয়ে গেছেন বাঁধেই। কেন ফিরে যাননি? এই প্রশ্নের জবাবে বাসন্তি মুন্ডা বলেন, ' আমরা ঘর পাইনি, কারণ নিয়ম অনুযায়ী ঘর পেতে হলে একখণ্ড জমি থাকতে হয়। আমাদের কিছুই নেই। আমাদের ভিটাবাড়ি নদী হয়ে গেছে। আমার বাবা—মায়ের একটু জমি ছিল তাই তারা ঘর পেয়েছেন।'

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই—একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা নাহলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটা। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয় নারীদের। কারণ লোকালয়ে আর গাছ কোথায়, লবণাক্ত মাটিতে বহুদিন কোনো গাছ জন্মায় না সাতক্ষীরা জেলার এ উপকূলীয় অঞ্চলে। শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়।

লবণাক্ততার কারণে ফসল হয় না। কাজের খোঁজে পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা রয়ে যায় সন্তান, বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্বে। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। পুরুষ না থাকায় নিরাপত্তাহীনতাও তার। অরক্ষিত জীবন। তারপর হয়তো কখনও গ্রামও ছাড়তে হয়। শহরে বস্তিতে এসে ইটভাটা আর পোশাক কারখানার শ্রমিক হতে হয়। কয়রা ও শ্যামনগর অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এখানকার উন্নয়নকমী সুপর্ণা সরকার জানালেন, দিনে দুইবার এখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় ফলে প্রায় ৭—৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন।

নারীরা পরিবেশের মৌলিক সবকিছুর সঙ্গেই নিয়োজিত থাকেন। স্বাস্থ্য, অধিকারসহ প্রভৃতি জায়গা থেকে তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। দুর্যোগ সহনশীলতায় নারীকে নাজুক হিসেবে না দেখে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাকে দেখতে হবে। যেমন নারীরা যে মুঠো চাল সংগ্রহ করে রাখেন, দুর্যোগের সময় এটি অনেক বেশি কাজে লাগে। নারীর এই বহুমাত্রিক ভূমিকা চিন্তা করেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট রোধে ও মোকাবিলায় নারীরা যে শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে এই বিশ্বাস রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রেখে এ—সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করতে হবে। নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হবো। কারণ নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীল তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান।

২০২১ সালে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় কপ—২৬ সম্মেলনে 'নারী ও জলবায়ু' শীর্ষক আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন নারীরা। তাই জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাও জরুরি। আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতীয় কৌশল কর্মপরিকল্পনার দলিল ঘোষণা করে।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সরকার গঠন করেছে 'বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড', যার চৌদ্দশত কোটি টাকার পুরোটাই সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের অর্থায়নে দেশে গঠন করা হয়েছে 'ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড'। যদিও উন্নয়ন অংশীদারগণ এই ফান্ডের প্রতিশ্রুত অর্থ এখনও ছাড় করেননি। ফলে তহবিলটি কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা চালু করেছে। কম কার্বন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথনির্দেশনা দিতে এটি কাজ করবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় প্রথমেই উপকূল অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এসব অঞ্চলে খাবার পানি কিনে খেতে হচ্ছে, ফলে খাবারের টাকায় টান পড়ছে। নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ঝুঁকিতে পড়ছে। দুর্যোগকালীন এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দুর্যোগ মোকাবিলায় শক্তিশালী খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি—২০২০, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের যেসব নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে তার সুফল নারীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষতিপূরণ দাবি ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারকে দরকষাকষির দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণে জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীর অনুদানের অর্থ সরাসরি নারীর হাতে দিতে হবে। তার জন্য মোবাইল ব্যাকিং করা যেতে পারে। কারণ বেশিরভাগ নারীরই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না। তাই নারীর এ অর্থ থেকে বঞ্চিত হবার সুযোগ থেকে যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram