চৌগাছা প্রতিনিধি : যশোরের চৌগাছা এলজিইডি (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) অফিসের হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান নিজেই ঠিকাদারি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্ত্রী ফারজানা নাহিদকে কাগজে কলমে দেখিয়ে নিজেই ঠিকাদারি কাজ করেন বলে অভিযোগ। একইসাথে ঠিকাদারি কাজের বিল নিরীক্ষার সাথে দায়িত্বপালনকারী একজন কর্মচারী হয়ে তিনি কিভাবে নিজেই ঠিকাদারি করেন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা।
সম্প্রতি উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে (ইউআরসি) পিইডিপি—৪ এর অধীনে মেরামত ও এসি সরবরাহ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। কাজটি কারসাজি করে নিজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টার প্রাইজের নামে নেন চৌগাছা এলজিইডির হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান। দরপত্র দলিল (শিডিউল) অনুযায়ী রিসোর্স সেন্টারের প্রশিক্ষণ কক্ষের মেঝে টাইলস, মূল কলাপসিবল গেইট স্থাপন এবং এসি স্থাপন কাজ করার কথা। সিডিউলে চারটি ২টনের এসি স্থাপনের কথা থাকলেও তিনি ২টি ২টনের এবং ২টি ১.৫টনের এসি সরবরাহ করেই চারটি ২টনের এসি স্থাপন হয়েছে বলে চলতি বিল দাখিল করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিইডিপি—৪ এর আওতায় উপজেলা রিসোর্স সেন্টার মেরামতের কাজের টেন্ডার আহবান করা হয় গত ২মে। কাজের প্রক্কলিত মূল্য ছিলো ৮ লাখ ১৬ হাজার ৯২৯ টাকা। ৮ অক্টোবরের মধ্যে কাজটি সম্পাদনের শর্তে গত ৯আগস্ট উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ কাজটির কার্যাদেশ দেন। একইদিন দরপত্র চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তিমূল্য ছিলো ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭২টাকা। চুক্তিপত্রে ফারজানা নাহিদের ছবি এবং স্বাক্ষর থাকলেও তিনি চৌগাছা এলজিইডি অফিসে এসে স্বাক্ষর করেননি বলে অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী নিশ্চিত করেছেন।
তারা বলেন, হিসাব রক্ষক নাজমুল নিজেই তার স্ত্রীর স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। তাছাড়া হিসাব রক্ষক নিজেই ঠিকাদার হওয়ায় কার্যাদেশের দিনেই চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। তা না হলে কার্যাদেশ পেতে ঠিকাদারের অন্তত একদিন সময় লাগার কথা।
আরও জানা গেছে, কাজটি সম্পাদন না করেই এমনকি ২টনের ৪টি এসি না দিয়েই চলতি বিল দাখিল করা হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর। যেখানে ২টনের ৪টি এসির বিল দাখিল করা হয়েছে ভ্যাট ও আইটি ছাড়া ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৫টাকা (দরপত্র দলিল মূল্যে)। অথচ কাজটির চুক্তিমূল্য অনুযায়ী এটি ১০ শতাংশ কম মূল্যে সরবরাহ করার কথা। এক্ষেত্রে চৌগাছা এলজিইডি অফিসের উপ—সহকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহমেদ বিল তৈরি করার সময়, হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান নিরীক্ষার সময় বা উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ বিলে স্বাক্ষর করার সময় কোথাও ৮টনের জায়গায় ৭টন এসি সরবরাহের কথা বা ১০ শতাংশ নিম্ন দরে কাজ সম্পাদনের কথা উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে ইউআরসিতে এসি সরবরাহ বা কোন কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারী ফারজানা নাহিদ বা তার কোন প্রতিনিধি যাননি বলে ইউআরসি সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, সেখানে এসি সরবরাহ করেছেন এলজিইডির হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান।
চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা গেছে, ছয়—সাত বছর ধরে নাজমুল আহসান চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরের হিসাব রক্ষক হিসেবে পোস্টিং পেয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই উপজেলার এলজিইডির অধীন সকল উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ নিজে নিতে প্রভাব খাটানো শুরু করেন। এ নিয়ে তার স্থানীয় একাধিক ঠিকাদারের সাথে, এমনকি কয়েকজন অফিস স্টাফের সাথেও বিরোধ ও তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটেছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের কাজ সম্পূর্ণ না করেই হস্তান্তরের কাগজে স্বাক্ষর করা নিয়ে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে মারতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন এই হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, হিসাবরক্ষক নাজমুল তাদের সাথে একাধিকবার খারাপ ব্যবহার করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে হিসাব রক্ষক নাজমুল আহসান বলেন, আমি অফিসে বিল নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করি, সে হিসেবে ফাইল তো আমিই ড্রিল করবো। সরকারি চাকরি করেও ঠিকাদারি করেন প্রশ্নে তিনি বলেন, না আমি করি না, আমার শ^শুর ওই ঠিকাদারের প্রতিনিধি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নাহিদ এন্টার প্রাইজের স্বত্বাধিকারী ফারজানা নাহিদ আপনার কি হন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার শ^শুরের মেয়ে। শ^শুরের মেয়ে আপনার কি হন প্রশ্নে বলেন ‘আমার স্ত্রী।’
কাজ সম্পন্ন না করেই বিল দাখিল করেছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা তো সম্পূর্ণ কাজের বিল না, চলতি বিল। যে কাজ করাই হয়নি সে কাজের চলতি বিল হলো কিভাবে প্রশ্নে তিনি বলেন, চার মাস আগে এসিগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। এখনও বিল পাইনি। তাই ইউএনও স্যারের কাছে বিলটির তদবিরে গিয়েছিলাম। ১টন এসি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরে ইউআরসির অন্য একটি রুমে দিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে। তাহলে স্টিমেটে ২টনের ৪টি এসি ধরা হয়েছে কেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা উপজেলা প্রকৌশলী বলতে পারবেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার মেরামত ও এসি সরবরাহ কাজের সাথে অভিজ্ঞতা সনদ হিসেবেই তিনি ২০১৮—১৯ ও ২০২০—২১ অর্থ বছরে ৮১ লাখ টাকায় চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭৩ লাখ টাকায় দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫২ লাখ টাকায় ঝিনাইকুন্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৭—১৮ অর্থ বছরে ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলার সুখপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলি নির্মাণকাজের সনদ দিয়েছেন। গত ৬মে চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ যার পেমেন্ট সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অর্থাৎ এই ঠিকাদার যে কাজগুলি করেছেন তার নিশ্চয়ন সনদ দিয়েছেন। এছাড়াও এডিপি, জাইকা, পিইডিপি ও জিওবিসহ বিভিন্ন ফান্ডের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি তিনি নিয়মিত করেন।
উপ—সহাকারী প্রকৌশলী বুলবুল আহমেদ বলেন, বিষয়টি দেখছি। চলতি বিল দাখিল করায় বিষয়টি সেভাবে দেখা হয়নি। যেটুকু কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি চলতি বিল দাখিল হয়েছে কিভাবে প্রশ্নে তিনি বলেন, স্টিমেটটা অনেক আগের। বিষয়টি ভালো করে দেখছি।
উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ বলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী হিসাব রক্ষক ঠিকাদারি করতে পারেন না, তবে তার স্ত্রী তো সরকারি চাকরি করেন না। তিনি বলেন, ঠিকাদারের প্রতিনিধি বিল দাখিল করেছেন। আর অফিসে বিল নিরীক্ষার কাজতো হিসাব রক্ষকই করে থাকেন। ৮টন এসি সরবরাহ না করেই চলতি বিল দাখিল বিষয়ে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরে ওই ১টন এসি দিয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। হিসাব রক্ষকের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, বিল দাখিল হওয়ার পর খেঁাজ নিয়ে জেনেছি সেখানে ৮টনের জায়গায় ৭টন সরবরাহ করা হয়েছে। ঠিকাদারকে কাজ সম্পূর্ণ করার পর বিল দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। এলজিইডির হিসাব রক্ষক নিজেই ঠিকাদারি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি আমার জানা নেই। তবে হিসাব রক্ষক বারবার বিলটি ছেড়ে দেয়ার জন্য তদবির করেছেন। ইউএনও বলেন, সরকারি কর্মচারী হয়ে তিনি ঠিকাদারি করতে পারেন না। তাছাড়া তিনি নিজেই তো বিল নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।