সমাজের কথা ডেস্ক : শেষবারের মত একসময়ের আপন আঙিনা এফডিসিতে এলেন প্রবীর মিত্র, তবে নিথর দেহে।
সোমবার দুপুর ১টায় এই শিল্পীর মরদেহ যখন এফডিসিতে আনা হয়, তাকে দেখতে ভিড় করেন তার সহশিল্পী, চেনা পরিচালক-প্রযোজকরা। তাদের ফুলেল শ্রদ্ধা আর চোখের জলে ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোববার রাত ১০টা ১০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান প্রবীর মিত্র; অভিনেতার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। রাতে ফ্রিজিং গাড়িতে করে মরদেহ রাখা হয়েছিল ধানমন্ডির বাসায়।
নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে প্রবীর মিত্র গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফুসফুসের সংক্রমণ ও রক্তক্ষরণের কারণে বর্ষীয়ান এই অভিনেতার শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। শেষমেশ তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
এফডিসিতে যে মঞ্চে প্রবীর মিত্রের মরদেহ রাখা হয়েছিল, তার পাশেই একটি গাছের নিচে বাবা সিফাত ইসলামের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মাহিয়ার মোহাম্মদ ঈষান। প্রবীর মিত্রের নাতি সে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে ঈষান জানায়, সে তার দাদাকে অনেক মিস করবে।
"দাদাকে অনেক মানুষ চিনতেন। কিন্তু এত মানুষ তাকে ভালোবাসেন, এটা এখানে এসে বুঝতে পারছি।"
অভিনয় জগতে এই অভিনেতা প্রবীর মিত্র নামে খ্যাতি কুড়ালেও তার নাম হাসান ইমাম।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, "প্রবীর মিত্র যখন বিয়ে করেন তখন তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তার নামকরণ করা হয় হাসান ইমাম। উনার ছেলের নামও কিন্তু ইসলাম ধর্মমতেই রাখা হয়েছে। উনি মুসলিম, তাই জানাজা এবং ইসলাম ধর্মমতে উনাকে দাফন করা হচ্ছে।" বুধবার প্রয়াত নায়িকা অঞ্জনা রহমান এবং প্রবীর মিত্রের স্মরণে দোয়ার আয়োজন করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন মিশা।
ফডিসিতে প্রবীর মিত্রকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর কাতারে ছিলেন আলমগীর, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, শাহীন সুমন, চয়নিকা চৌধুরী, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু, অভিনেতা বাপ্পি চৌধুরী, ডিএ তায়েব, নায়িকা মুক্তিসহ আরো অনেকে।
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, ক্যামেরাম্যান এসোসিয়েশন, চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি-বাচসাস এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি)।
চলে গেলেন প্রবীর মিত্রও
চিত্রনায়িকা মুক্তি বলেন, "আমাদের শিল্পীদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কটা আরো শক্ত হওয়া উচিত। আমরা যখন একসঙ্গে কাজ করি, তখন সবাই সবার সঙ্গে থাকি, পাশে থাকি। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলে অনেক সময় আর খোঁজ রাখি না। এটা হওয়া উচিত নয়।"
“প্রবীর মিত্র আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবেন", বলছিলেন অভিনেতা ডি এ তায়েব।
জানাজার আগে প্রবীর মিত্রের বড় ছেলে মিথুন সবার উদ্দেশে বলেন, "আমার বাবার কোনো কথা বা আচরণে যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে মাফ করে দেবেন।"
দুপুর পৌনে ২টায় এফডিসি থেকে মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে, সেখানে অভিনেতার আরেকটি জানাজা হয়েছে।
সেখানে ছিলেন সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম, ফুয়াদ নাসের বাবু, অভিনয়শিল্পী খাইরুল আলম সবুজ, মিশা সওদাগরসহ প্রবীর মিত্রের পরিবারের সদস্যরা।
খুরশীদ আলম বলেন, "কিছুদিন আগে নায়িকা অঞ্জনাকে হারালাম, এখন প্রবীর মিত্র চলে গেলেন। ইন্ডাস্ট্রির অনেক ক্ষতি হল।
"সিনেমা, গানে আশির দশককে আমি গোল্ডেন টাইম মনে করি। সেই সময়ের একজন উজ্জল নক্ষত্র চলে গেলেন।"
চ্যানেল আই প্রাঙ্গণ থেকে আজিমপুর কবরস্থানে যাওয়া হয় প্রবীর মিত্রের মরদেহ। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন এই অভিনেতা।
১৯৪০ সালে চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া প্রবীর মিত্রের শৈশব কেটেছে পুরান ঢাকায়। পড়াশোনা করেন সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল ও জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)।
স্কুলজীবনে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে প্রহরীর চরিত্রে অভিনয় করেন প্রবীর মিত্র। পরবর্তী সময়ে পরিচালক এইচ আকবরের হাত ধরে ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয় তার।
প্রায় চার দশকের অভিনয়জীবনে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেন তিনি।
সবশেষ এসডি রুবেলের পরিচালনায় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ে জন্য পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান প্রবীর মিত্র; ২০১৮ সালে পান আজীবন সম্মাননা।