মনিরুজ্জামান মনির : টানা ১৫দিনেও বিষক্রিয়া নষ্ট হয় না এমন ক্ষতিকারক কীটনাশক স্প্রের পরদিনই বাজারজাত করা হয় সুস্বাদু সবজি বেগুন। পোকামুক্ত বেগুন উৎপাদন করতে কৃষকদের ১৫দিন কার্যকর থাকে এমন কীটনাশক প্রতিদিনই স্প্রে করতে হচ্ছে। এরপরেও পোকামুক্ত বেগুন উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে কৃষক। ভোক্তারা উচ্চমূল্য দিয়ে শুধু বেগুন কিনছে না সাথে ফ্রি হিসেবে পাচ্ছেন বিপদজনক বিষ। এ বেগুন বেশিদিন সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজে রেখে ফ্রিজটাকেও বিষময় করে তুলছেন ভোক্তারা।
অুনসন্ধানে জানাযায়, দেশের বাজারে তিন ধরনের কীটনাশক বিক্রি হয়। কীটনাশকের বোতলের গায়ে লাল, হলুদ ও সবুজ চিহ্ন দেয়া থাকে। লাল চিহ্নের বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে এক মাস পর্যন্ত। হলুদ চিহ্নের বিষক্রিয়া থাকে ১৫ দিন। আর সবুজ চিহ্ন ৩ থেকে ৭দিন।
বেগুন চাষিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে তারা যে বিষ ব্যবহার করেন তার গায়ে হলুদ চিহ্ন দেয়া থাকে।
সরেজমিন বিভিন্ন বেগুন ক্ষেতের পাশে পড়ে পাওয়া বিষের বোতল ও প্যাকেটের গায়েও হহুদ চিহ্ন দেখা গেছে। এসব বিষের মধ্যে রয়েছে মনোমী, রুপম, ডেসিস, ভারর্টিমেক, উলালা রিমলী এবং সবিক্রন । হলুদ চিহ্নের তরল এ কীটনাশকের সাথে পাউডার জাতীয় কীটনাশক মিশিয়ে স্প্রে করেন চাষিরা। পাওডার কীটনাশকের মধ্যে রয়েছে একতারা, ইটিগোল্ড, অটোমিডা, এরোস্টার, ভির্তাকো, পাইরাজিন ইত্যাদি। একই সাথে ব্যবহার করছে বিভিন্ন ছত্রাকনাশক এবং ভিটামিক্সসহ বোরণ জাতীয় কীটনাশকও। কৃষক বেগুনে ১৮ লিটার ড্রামে একই সাথে ৫ থেকে ৭ প্রকারের কীটনাশক মিশিয়ে স্প্রে করছে।
কৃষক শেখ সাদী জানান, ‘এ বছর বেগুনে রিমলী কীটনাশক স্প্রে করেছি। সাথে কনফিডর আর ছত্রাকনাশক সেভেন পাউডার দেই। আসল কথা হলো স্প্রে না করলে বেগুনে সব পোকা হয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে শীতের কারণে স্প্রে কম করছি। সেখানেই ৬০ কেজি ভালো হয়েছে ভালো আর ৫০ কেজি হয়েছে পোকা। বাজারে যে কীটনাশক তা একদিন পর স্প্রে করলেও কাজ হয় না। আগে কীটনাশক দিলেই কাজ হতো এখন তেমন হয় না। বেগুনের যে দাম তাতে প্রতিদিন স্প্রে করতে হচ্ছে।’
কোদালিয়া গ্রামের বেগুন চাষি সাইদুর রহমান জানান, বেগুনে একদিন পর পর স্প্রে করা হয়। কয়েকদিন অতিরিক্ত শীতের কারণে স্প্রে একটু কম করেছি। তাও সপ্তাহে দু’দিন। তবে বেগুনের দাম যা বাড়ছে এখন প্রতিদিনই স্প্রে করতে হবে। বেগুন পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ২৬’শ থেকে ২৭’শ টাকা। দাম এভাবে থাকলে কীটনাশক দেওয়া বন্ধ করা যাবে না। পোকা হলেই লস। অনেকে বেগুনে ইন্ডিয়ান দামি তেলও ব্যবহার করছে।
আমার ৩ মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি কীটনাশকই লাগছে। ২৫ শতক জমিতে ৪ ড্রাম পানি স্প্র করা লাগে। প্রতি ড্রামে ৩ থেকে সাড়ে ৩’শ টাকার কীটনাশক লাগে। সত্য কথা বলতে ভাই আমরা বেগুন খাইনে বিষ খাই। আজ কীটনাশক দিয়ে কাল বাজারে নিয়ে যায়। আমরা বেশির ভাগ কৃষক কীটনাশকের সম্পর্কে ভালো বুঝি না। হলুদ, লাল এবং সবুজ চিহ্ন কি জানিনা । যখন যেটা দোকানদার বলে সেটাই ব্যবহার করা হয়। আমরা নিজেরাও স্প্রে করতে করতে শেষ।’
দৌলতদিহী গ্রামের কৃষকের ছেলে আসিফ হোসেন জানান, ‘ বেশিরভাগ সময় বেগুনে আমিই স্প্রে করি। আব্বার বয়েস হয়েছে তেমন ভালো বোঝে না। আজ স্প্রে করছি কয়েক প্রকারের তেল। বেগুনে পোকার জন্য মনোমী এবং রুপম দেওয়া হয়েছে। সাথে টনটন, ভিটামিক্স, পার্ক এবং বোরণও দেওয়া হয়।’
বীর নারায়নপুর গ্রামের কৃষক উত্তম ঘোষ জানান, ‘বেগুনে কয়েক প্রকারের কীটনাশক ব্যবহার করি। কয়েক প্রকারের পাতা জাতীয় পাউডারের সাথে সবিক্রন কীটনাশক তেলও মিশিয়ে স্প্রে করি। তবে শীতে একটু স্প্রে কম করি। সামনে গরমের টান আসছে এখন থেকে পোকা মারতে হলে স্প্রে বেশি করতে হবে।’
যশোর কৃষি অধিদপ্তারের অতিরিক্ত উপপরিচালক(শস্য) সমরেন বিশ্বাস জানান, কৃষকরা যাতে বুঝে কীটনাশক ব্যবহার করে এ বিষয়ে মাঠ দিবস করে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে সব কীটনাশকের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এগুলো কৃষকদের ব্যবহারের সাথে আমাদেরও সতর্ক হতে হবে। সাধারণত পাউডার জাতীয় কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশকেরও ৩ থেকে ৭ দিন বিষক্রিয়া থাকে।
যশোর কৃষি অধিদপ্তারের উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, কীটনাশক ব্যবহারের ৭ থেকে ১০ দিন ওয়েটিং প্রেয়োড করতে হয়। প্রতিটা কীটনাশকের বডিতে চিহ্ন দেওয়া থাকে। এই চিহ্ন থেকে বোঝা যায় কোন কীটনাশকের মাত্রা কতটুকু। লাল চিহ্ন দেওয়া কীটনাশকের মাত্রা ১৫ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত থাকে। আর এ কারণে লাল চিহ্নর কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হলুদ চিহ্নের কীটনাশক ব্যবহারের ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত ফসলে বিষ ক্রিয়া থাকে। সবুজটার ৩ থেকে ৭ দিন বিষক্রিয়া থাকে। আসলে কীটনাশক ডোজ অতিরিক্ত ব্যবহার মানেই ক্ষতি।
কৃষক ভুল পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবার মানুষেরও ক্ষতি করছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বড় ধরণের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কৃষকদের আমরা সবজি ক্ষেতে পোকা দমনের জন্য ফেরোমন ফাঁদ, ফেরোমন ট্র্যাফ, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও স্প্রে করার সময় নানা উপকরণ ব্যবহার করে ফসলে কীটনাশক দেওয়ার কথাও বলছি। তবে যারা ৭ দিনে ৩ বার সবজিতে কীটনাশক ব্যবহার করছে তাদের নিকট আমাদের যাওয়া প্রয়োজন।