৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
গোলাপে রেকর্ড দাম, তবুও শঙ্কায় কৃষক!

শাহ জামাল শিশির, ঝিকরগাছা (যশোর): গানে গানে দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গেছেন, ‘হলুদ গাঁদার ফুল,/ রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে, এনে দে,/ নইলে বাঁধব না বাঁধব না চুল...! কবি গানের এই লাইনেই জানিয়ে দিয়ে গেছেন বসন্তে নারীর জন্য গাঁদা ফুলের প্রয়োজনীয়তা।

আগামীকাল পয়লা ফাল্গুন, বসন্ত বরণ উৎসব ঘিরে গাঁদা ফুলের চাহিদা বাড়ছে। ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীর পাইকারি বাজারে গাঁদা ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি গাঁদা ফুলের দামও বাড়ছে হু হু করে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই ফুলের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে সাতগুন পর্যন্ত।

<<আরও পড়তে পারেন>> তিন দিবস ঘিরে চাঙ্গা গদখালি ফুলের বাজার

ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ ফুলের দাম আরো বাড়বে। বসন্ত উৎসবের দিনে বিশ্ব ভালবাসা দিবস হওয়ায় এদিন গোলাপের চাহিদাও থাকে সর্বোচ্চ। ফুলচাষিরা বলছেন, রেকর্ড সর্বোচ্চ দামে এবছর গোলাপ বিক্রি হয়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ায় কম ফুল উৎপাদন এবং চড়া বাজারে ইন্ডিয়ান গোলাপের আগমনে তাদের মনে লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে।

সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রেকর্ড সর্বোচ্চ দামে গদখালী বাজারে গাঁদা ফুল কেনাবেচা হয়েছে। প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে। গত সপ্তাহে সমপরিমাণ ফুল ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। গাঁদা ফুলের এমন দামে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ভীষণ খুশি।

একই দিনে গোলাপের রেকর্ডদাম থাকলেও গতদিনের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। এদিন গোলাপ বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ২০—২৫ টাকা। অথচ একদিন আগে রোববার গোলাপ বিক্রি হয়েছিল মানভেদে ২৫—৩০ টাকা পর্যন্ত। চায়না গোলাপের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
এদিন প্রতিপিস রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা, রঙিন গ¬াডিউলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৫ টাকা। ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি অঁাটি ৩০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়।

সোমবার সকালে গদখালী ফুলের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কাকডাকা ভোর থেকেই কৃষকেরা বড় বড় ঝুড়ি ও বস্তাভর্তি করে গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছেন মোকামে। যশোর—বেনাপোল মহাসড়কের পাশের ফুলের আড়তে তারা গাঁদা বিক্রি করছেন। কেউ কেউ ভ্যানের ওপর থেকে নিজেরাই গাঁদা ফুল বিক্রি করছেন।

একদিকে চলছে ফুলের বেচাকেনা অন্যদিকে নারীরা সুই সুতো দিয়ে করছেন মালা গাঁথার কাজ। তাদের গাঁথা মালা বিভিন্ন পরিবহণে করে ঢাকাসহ দেশের জেলায় জেলায় পাঠানো হয়। এদিন গাঁদা ফুলের ভালো দাম পেয়ে অধিকাংশ কৃষকের মুখে চওড়া হাসি ফুটেছে। কৃষকরা বলছেন, এবার গাঁদা ফুলের দাম আরো বাড়বে।

পানিসারা গ্রামের কৃষক আরিফ হোসেন বলেন, সাড়ে ছয় হাজার গাঁদা নিয়ে হাঁটে এসেছি। প্রতি হাজার ফুল বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা দরে। সপ্তাহখানেক আগে এই ফুল বিক্রি করেছি প্রতি হাজার ১৫০ টাকা দরে।

হাড়িয়া গ্রামের গাঁদা ফুলচাষি বাবু জানান, গতকাল আর আজ (সোমবার) ভাল দামে গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে। তিনি হাজারপ্রতি ৪৫০ টাকা দরে চার হাজার ফুল বিক্রি করেছেন।

বেনেয়ালি গ্রামের শহিদুল গাজী বলেন, দশ হাজার গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছি। প্রতিহাজার বিক্রি হয়েছে ৬০০টাকা। এসব ফুল ক্রেতারা বসন্ত উৎসবের জন্য কিনছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে এই ফুলের দাম আরো বাড়বে।

ফুল ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, এবছর সর্বোচ্চ দামে গাঁদাফুল বিক্রি হচ্ছে। রবি ও সোমবার ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত প্রতিহাজার ফুল বিক্রি হয়েছে।

যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, এই অঞ্চলে অন্তত ৩০০ হেক্টর জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ হয়। বসন্তবরণ উৎসব ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গাঁদা ফুলের চাহিদা বাড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাঁদা ফুলের সর্বোচ্চ দাম থাকবে।

আড়তদারের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে ব্যাপারীরা গাঁদা ফুল কিনে স্থানীয় নারীদের দিয়ে মালা তৈরি করিয়ে নেন। ওই মালা বস্তাভর্তি করে সারা দেশের খুচরা ফুলের দোকানে পাঠানো হয়। গদখালী বাজার লাগোয়া সদিরালী গ্রামের অন্তত ২০০ নারী বাড়ির আঙিনায় বসে গাঁদা ফুলের মালা গাঁথার কাজ করেন।

প্রতিপিস মালা গাঁথা বাবদ তারা মজুরি নেন ২০ টাকা। এখন প্রতিদিন তারা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেল, নুপুর বেগমের বাড়ির বাড়ির উঠান ও বারান্দায় মালা গাঁথার কাজ করছেন দীপা, সামসুন্নাহার, সুমাইয়া, তহুরন, কোহিনুরসহ অন্তত দশ নারী।

নুপুর বলেন, সংসার সন্তান সামাল দিয়ে আমরা গাঁদা ফুলের মালা গাঁথার কাজ করি। এখন কাজের চাপ অনেক বেশি। ব্যাপারীরা আমার কাছে ফুল ও সূতা দিয়ে যান। যে যত বেশি মালা গাঁথতে পারবে সে ততো টাকা পাবে।

দীপা বলেন, প্রতিটা মালার জন্য ব্যাপারীরা ২০টাকা মজুরি দেন। এখন কাজের চাপ বেশি, প্রতিদিন ২০টা মালা গাঁথতে পারি। এখন ৪০০ টাকা আয় হচ্ছে।

গাঁদা ফুল গাঁথার কাজে ব্যস্ত বৃদ্ধা কোহিনুর বেগম বলেন, এই বয়সে এসে মালা গাঁথার কাজ করে আয় করতে পারছি এটাই বড় পাওয়া।
এদিকে সোমবার সকালে অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত গোলাপ বিক্রি না করতে ফিরে গেছেন। অনেকেই কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে কম দামে বিক্রি করেছেন। তাদের অভিযোগ, ভারত থেকে আনা গোলাপের কারণে সোমবার কৃষকদের গোলাপ বিক্রি কম হয়েছে।

হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের কৃষক রাসেল হোসেন বলেন, সোমবার বাজারে প্রচুর পরিমাণ গোলাপ উঠেছে। আমার গোলাপ বিক্রি না করতে পেরে বাড়ি ফেরত এনেছি। তিনি দাবি করেন, এদিন বাজারে প্রচুর পরিমাণ ভারত থেকে আনা গোলাপ উঠেছে, এজন্য বিক্রি কমে গেছে।

নীলকন্ঠনগর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, অনেক চাষি তাদের গোলাপ বিক্রি করতে পারেনি। ভোরের বাজারে ২০—২২ টাকা বিক্রি হলেও পরে দাম কমে যায়। সবাই বলছে, ইন্ডিয়ান গোলাপ আমদানির কারণে গোলাপের দাম পড়ে গেছে।

এবিষয়ে যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, এবছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে গোলাপের উৎপাদন কম হয়েছে। দাম বেশি পাওয়ায় কৃষক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতো। সোমবার হঠাৎ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভারত থেকে গোলাপ আমদানি করে। ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে ঢাকার ফুল ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, আমরা ভারত থেকে সারা বছরই চায়না গোলাপ আমদানি করি। এটার দাম স্বাভাবিক গোলাপের চেয়ে অনেক বেশি। এটা আমদানি করলে দেশের চাষিদের ক্ষতি হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই।

গদখালি বাজারের ফুল ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, আমি কোন ফুল আমদানির সাথে জড়িত না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের চাহিদার ভিত্তিতে আমদানিকারকের কাছ থেকে ফুল কিনে সরবরাহ করি।

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email[email protected]
পুরাতন খবর
FriSatSunMonTueWedThu
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930 
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram