কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) থেকে নয়ন খন্দকার : ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ‘গরিবের ডাক্তার’ আলমগীর হোসেন সবার সঙ্গেই হাসিখুশিভাবে কথা বলেন। রোগীরা স্বচ্ছন্দ্যে তার কাছে সব খুলে বলেন। সাধারণ রোগীদের তিনি বর্ণনা শুনেই ওষুধ দেন। জটিল রোগের চিকিৎসা তার দ্বারা সম্ভব না হলে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। সময় পেলে তিনি বাড়ি গিয়েও রোগী দেখে আসেন।
ডাক্তার আলমগীর হোসেন বললেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের সেবা করে যেতে চাই। তিনি গরীবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। চিকিৎসা প্রশাসনের বড় দায়িত্ব পালন করলেও নেই ব্যক্তিগত গাড়ি। সাদামাটা জীবনেই তার যত আনন্দ। আন্তরিক ব্যবহার আর পরামর্শে মানুষকে জাগিয়ে তোলেন তিনি। রোগীদের কোন ভিজিট নেন না। কোম্পানির স্যাম্পল পেলে তাও দিয়ে দেন গরিব রোগীদের। সৎ, পরোপকারী ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। প্রচারবিমুখ ডাক্তার আলমগীর হোসেন বিনয়ের সঙ্গে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ কর্মজীবনকে আড়ালে রাখতে চান।
সাদামাটা জীবনের বিষয়ে বলেন, চিকিৎসা বিষয়ে উন্নত ডিগ্রি নিইনি। চেম্বার জমানোর মতো সময় দেইনি। নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের চেষ্টা করেছি। পারিবারিক ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মা—বাবা সব সময় সত্য বলতে উৎসাহিত করেছেন। জীবনভর খুব বেশি প্রাচুয্যর্ না পেলেও সম্মান পেয়ে থাকি।
রোজিনা আক্তার নামের এক প্রসূতি মা উপজেলার সরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দ্বিতীয় বারের মতো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামের ইকবল হোসেনের স্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই সন্তান জন্মদানের জন্য অস্ত্রোপচারের স্থান ও চিকিৎসক ভেদে মোটা অংকের একটি চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয় রোগীকে। কিন্তু সরকারি এই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের কোনো খরচ ছাড়াই প্রসূতি রোজিনার আক্তারের চিকিৎসা সেবা চলছে। সরকারি হাসপাতালের এই সেবায় অভিভূত রোজিনা আক্তার ও তার পরিবার। সরকারি এই হাসপাতালে এভাবেই কোনো খরচ ছাড়া অস্ত্রোপচার করে চলেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেন।
উপজেলার ২০তম স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি তিনি বিনামূল্যে ৪০১ জন রোগীকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৩১৩ জন প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের সেবা দেন তিনি। ২০২২ সালে ১৬৬ জন এবং ২০২৩ সালে ১৪৭ জন প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচার করেন। এছাড়াও তিনি গত দুই বছরে ৫০ জনের এপেন্ডিসাইট, ১০ জনের হার্নিয়া, ২ জন রোগীর হাইড্রসিল এবং ২৬ জনের সুন্নতে খাৎনা অপারেশন করেন সম্পূর্ণ ফ্রি।
হাসপাতালে তিনি রোগী দেখেন সময় নিয়ে, রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, এমনকি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে অনেক গরিব রোগীর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ওষুধ ক্রয়ের ব্যবস্থাও করে দেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তার এমন সেবায় স্থানীয়রা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ইতোমধ্যে অনেকেই তাকে ‘গরীবের ডাক্তার’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন। শুধু ভালো ডাক্তারই নন একজন ভালো প্রশাসক হিসাবেও অধীনস্ত সহকর্মীদের নিকট প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছেন ডা. আলমগীর হোসেন।
স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে নিজ উদ্যোগে করেছেন হাসপাতাল চত্তরে ফুলের বাগান, সাইকেল গ্যারেজ, নার্সদের একটি নতুন ডিউটি কক্ষ (ব্যক্তিগত অর্থায়নে), আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও এক্সরে মেশিন সচল, ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে অপারেশন থিয়েটারের জন্য একটি জেনারেটরও প্রদান করেছেন। পুরো হাসপাতালের পরিষ্কার পরিছন্নতার দিকটিকে অগ্রাধিকার প্রদান করে ময়লা আবর্জনা রাখার নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করেছেন।
ইপিআই টিকা, সাপে কাটা এবং কুকুর বিড়ালের কামড়ের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা শেষ হওয়ার আগেই চাহিদাপত্র দিয়ে সংগ্রহ রাখতে ভুল হয় না এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার। কিছুদিন আগে হঠাৎ করে সারা দেশে স্যালাইনের সংকট দেখা দিলেও কালীগঞ্জ হাসপাতালে ছিলো না কোনো সংকট। সে সময় দূরদর্শী গুণে হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহ সচল রেখেছিলেন তিনি।
রোগীদের সরকারি ওষুধ সরবরাহ সংকটহীনভাবে ঠিক রেখে চলেছেন। প্রসূতি মায়েদের জন্য ১০ বেডের একটি আলাদা ওয়ার্ডও হাসপাতালে স্থাপন করেছেন। উপজেলার সরকারি এ হাসপাতালে ১৭ জন ডাক্তারসহ মোট ১৩৮ জন স্টাফের যথাযত দায়িক্ত পালন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দক্ষ নেতৃত্বে সেবার মান অনেক উন্নত হয়েছে বলে মনে করেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।
উপজেলার সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেন জানান, যোগদানের পর থেকে সকল সহকর্মীকে সাথে নিয়ে উপজেলাবাসীর চিকিৎসা সেবায় গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমি কাজ করে যাচ্ছি। চিকিৎসা সেবা একটি মহৎ পেশা। রোগীদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারলে নিজের মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দের অনুভূতি কাজ করে।
ইতোমধ্যে আমি ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, বলরামপুর ও বারবাজার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ১০ শয্যার বেড স্থাপন, পুরো হাসপাতাল এলাকায় জরাজীর্ণ পুরাতন প্রাচীরের স্থানে নতুন ভাবে বাউন্ডারি দেওয়া, নতুন দ্বিতল ভবনের উপর ৩য় তলা নির্মাণ ও একটি কনফারেন্স কক্ষের জন্য প্রস্তাবনা প্রদান করেছি। এই কাজগুলোর বাস্তবায়ন হলে সেবার মান আরো বৃদ্ধি পাবে আশা রাখি।