সমাজের কথা ডেস্ক : দেশে খেলাপি ঋণ ছাড়াল দেড় লাখ কোটি টাকা।
বিশেষ ছাড় দেওয়ার পরও লাফিয়ে বাড়ল খেলাপি ঋণ। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন; তিন মাসে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আর গত ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি সব খাতের ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণের হার ফের ১০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে গত টানা তিন বছর ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এবারে তা প্রত্যাহারের চিন্তা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। এর পর আবারও ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় দিয়ে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবারের সার্কুলারে ছাড়ের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বহির্বিশ্বে যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় ঋণের কিস্তি সম্পূর্ণ পরিশোধে অসুবিধার মুখে পড়ছেন ঋণগ্রহীতারা। ছাড় অনুযায়ী, গত ১ এপ্রিল থেকে নিয়মিত মেয়াদি প্রকৃতির ঋণের (স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণসহ) বিপরীতে এপ্রিল—জুন সময়ের জন্য যে কিস্তি দিতে হবে, তার ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলে গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। তবে অবশিষ্ট অর্থ সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এসব ঋণ যথানিয়মে খেলাপি করা যাবে। যেসব গ্রাহক এই সুবিধা নেবেন, তাদের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনোরূপ দণ্ডসুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত ঋণের ক্ষেত্রেও এই সুবিধা প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ছাড়ের সুবিধাকে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছেন ঋণগ্রহীতারা। তারা আর ঋণ ফেরত দেননি। এতে অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। বারবার ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে এখন সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তা ছাড়া যারা বছরের পর বছর বারবার সুবিধা নিয়েও ঋণ ফেরত দিচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও দেখা যায় না। ফলে ঋণখেলাপিদের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে, ঋণ ফেরত না দিলেও কিছুই হয় না।
আবার ব্যাংকগুলো খেলপি ঋণ আদায়েও যথেষ্ট সচেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। তারা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় না।
<< আরও পড়ুন >> ‘ফ্রিল্যান্সারদের কোনো উৎসে কর দিতে হবে না’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। তিন মাস আগে গত মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ফলে গত ছয় মাস ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, পরিমাণের দিক থেকে এর আগে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উঠেছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। আর শতাংশ হিসেবে এর আগে ২০১৯ সালের জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের হার দুই অঙ্কের বেশি উঠেছিল। ওই সময় খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তবে এই সংকটকে দীর্ঘদিনের সমস্যার ধারাবাহিকতা বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অথচ এ সময়ে ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ সব ধরনের সুবিধার দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে।
কোনো সুবিধাই খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর হাতে ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষমতা দেওয়ার ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে এখন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’