মনিরুজ্জামান মনির : ইউনিয়ন পরিষদের দেয়ালে ঝুলানো ‘কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড’ কৃষকদের কোনো উপকারে আসছে না। আবহাওয়ার তথ্যহীন এসব বোর্ড যে আছে, তাও জানে না অনেক কৃষক। এমন অনেক বোর্ড রয়েছে যা টাঙ্গানোর পর কোনোদিনই তথ্য পরিবর্তন করা হয়নি। কৃষক ও কৃষি বিভাগের পরিবর্তে বোর্ডগুলো আগলে রেখেছে মাকড়সা।
কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাতে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প চালু করে। প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে স্থাপন করা হয় কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোড, রেইন গেজ মিটার ও সৌর প্যানেল। এটি পরিচালনার জন্য ওই সময় প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে দুই দিনের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে আবহাওয়াবিষয়ক সফটওয়্যারসহ প্রত্যেককে একটি করে ট্যাবও দেয়া হয়। সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সরকারিভাবে প্রতি মাসে তাদের ইন্টারনেট প্যাকেজও দেয়া হয়।
ডিসপে¬ বোর্ডে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আদ্রতার হার, বায়ুপ্রবাহ, দিনের আলো কতক্ষণ থাকবে ও ঝড়ের পূর্বাভাসসহ ১০টি তথ্য ছক রাখা হয়। এই বোর্ড থেকেই তিন দিন আগের ও তিন দিন পরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার সুযোগ রয়েছে কৃষকদের। কিন্তু এসব বোর্ড স্থাপনের পর থেকেই নেই কোনো কার্যক্রম। অবহেলা আর অযত্নে দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে আছে। কোথাও চুরি হয়ে গেছে রেইন গেজ মিটার ও সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে কৃষি আবহাওয়া তথ্য কার্যক্রম প্রকল্পটি।
তবে যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর, লেবুতলা এবং কাশিমপুর ইউনিয়নের কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি নিয়মিত না হলেও আবহাওয়া পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু খেঁাজ নিয়ে জানা যায়, পাশাপাশি তিনটি ইউনিয়নের আবহাওয়া তথ্য ভিন্ন। কোথাও গরমকালের তথ্য থাকলে কোথাও আছে শীত। এমন কি বদলি হওয়া কৃষি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বরও পরিবর্তন করা হয়নি। কর্মরত কৃষি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর দেওয়া নেই।
লেবুতলা গ্রামের কৃষক আ. আজিজ জানান, ‘১ বিঘা ১২ কাঠা জমিতে আগাম বাঁধাকপির চাষ করেছি। কিন্তু কোনোদিন কৃষি অফিসারদের দেখা পাইনি। তাদের সবসময় কীটনাশকের দোকানে দেখা যায়। তারা মাঠে আসেন না। আবহাওয়া সম্পর্কে কৃষি স্যারদের কাছ থেকে কোনো তথ্য আমরা পাই না। ইউনিয়ন পরিষদে যে আবহাওয়ার বোর্ড আছে তা আমরা বুঝিও না। আবহাওয়া সম্পর্কে জানালে খুব ভালো হয়। আশপাশ থেকে আবহাওয়া সম্পর্কে যা জানি অনেক সময় তা সঠিক হয় না।’
আব্দুলপুর গ্রামের কৃষক সেলিম হোসেন জানান, ‘আবহাওয়া সম্পর্কে কৃষি কর্মকর্তা আমাদের কিছু বলে না। আমরা এখন মোবাইল থেকে দেখি। তবে আবহাওয়া তথ্য জানা সবজি চাষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
কাশিমপুর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, আবহাওয়া তথ্য বোর্ড পরিবর্তন নিয়মিত হয় না। মাঝে মধ্যে করা হয়।
হৈবতপুর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাসান আক্তার জানান, ‘আবহাওয়া বোর্ড নিয়মিত করার চেষ্টা করি। তবে মাঝেমধ্যে করা হয় না। অনেক সময় কৃষকদেরকে মোবাইল ফোনে কথা বলে আবহাওয়া সম্পর্কে জানানো হয়। আমরা সবসময় কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। তবে সব কৃষকের মনজয় করা সম্ভব হয় না। এজন্য আমাদের বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলে। আমরা তো ইউনিয়নের কৃষকদের জন্যই আছি।’
লেবুতলা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামিম হোসেন বলেন, আবহাওয়া বার্তার চার্টটা নিয়মিত পরিবর্তন করা হয় না। তবে বৃষ্টির সময় করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে পরিবর্তন করেছেন কি—না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে পরিবর্তন করা হয়নি। কৃষকদের আবহাওয়া সম্পর্কে কোনো সতর্ক করেন কি—না এবং মোবাইল অ্যাপস’র মাধ্যমে বার্তা দেন কি—না জানতে চাইলে তিনি জানান, মাঝে মাঝে জানানো হয়। কিন্তু মোবাইল অ্যাপস’র মাধ্যমে বা ফোন করে সতর্ক করা হয় না। ইউনিয়ন পরিষদের আবহাওয়া চার্ট কৃষকেরা বোঝে কি—না বা কোনো দিন বুঝিয়েছেন কি—না জানতে চাইলে তিনি জানান, কৃষকেরা এটা বোঝে না।
যশোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ হাসান আলী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের আবহাওয়া বোর্ড নিয়মিত আপডেট করা হয়। কিন্তু লেবুতলা, কাশিমপুর এবং হৈবতপুর ইউনিয়নের আবহাওয়া একই হবে কি—না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু খুব বেশি দূরত্ব না সেহেতু ৩ স্থানের আবহাওয়া একই হওয়ার কথা।
তিনি জানান, কৃষকদের আবহাওয়া সম্পর্কে জানানো আমাদেরই দায়িত্ব। এবার নিয়মিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে।
যশোর জেলার কৃষি উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ হলো জনবহুল জায়গা। এখানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনেক মানুষ দেখতে পারে। আমাদের নির্দেশনা আছে প্রতিদিন আপডেট করা। তবে এটা দেখাশোনা করে উপজেলা কৃষি কর্মকতার্। ইউনিয়নের কৃষকদের আবহাওয়া সম্পর্কে জানানো ইউনিয়ন ভিত্তিক কৃষি কর্মকর্তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আবহাওয়া বোর্ড যদি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন না হয় তা হলে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাধারণ মানুষের অভিমত, কৃষকদের স্বার্থে সরকারের এ বড় আয়োজন এক প্রকার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঝড় বৃষ্টি শীত গরম কোনো তথ্যই কৃষকদেরকে দিতে পারছে না এ প্রকল্প। আবহাওয়া তথ্যের জন্য কৃষকদের গণমাধ্যমে সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। তবে গণমাধ্যমের তথ্যে আঞ্চলিক আবহাওয়া তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে কৃষকরা অনুমান নির্ভর আবহাওয়ার তথ্যে চাষাবাদ করছেন।