নিজস্ব প্রতিবেদক : কালো মেঘে বিকেলেই নামে সন্ধ্যা। এরপর আঘাত হানে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী। ক্ষণস্থায়ী ঝড়ের পরেই নামে বৃষ্টি। মুূষলধারে নামা বৃষ্টিতে উষ্ণ যশোর হয়েছে সিক্ত। তবে ঝড় বৃষ্টিতে পাকা ধান, আম, কাঁঠাল, ভুট্টা, গমসহ উঠতি ফসলের হয়েছে ক্ষতি । এ ছাড়া বজ্রপাতে ৩ জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে যশোরের অধিকাংশ এলাকায় ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। এতে পাকা ধানের ক্ষতির আশঙ্কা কৃষকদের। অনেক স্থানে পাকা ধান মাটিতে হেলে পড়েছে। এছাড়াও আম ও লিচুও ঝড়ে পড়েছে। এছাড়াও শাক-সবজিও উঠতি ফসলেরও ক্ষতির আশঙ্কা কৃষকের। তবে আশার কথা খরায় অকোঁজো টিউবওয়েলগুলো সচল হতে শুরু করেছে।
দুপুরের পর থেকেই মেঘ রোদের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়। ছিল মেঘের হাঁকডাক। দুপুরের দিকে রোদের দেখা মিললেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেঘে ঢেকে যায় পুরো আকাশ। বিকেল ৪টার পরে শুরু হয় ঝড়ের সাথে বৃষ্টি। থেমে থেমে বৃষ্টি নামে রাত অবধি।
এদিকে ঝড় বৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষদেরকে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি শুরুর সময় মানুষ দিকবিদক ছুটতে থাকে। বৃষ্টিতে শহরের দড়াটানা মোড়ে আশ্রয় নেয়া হাসানুজ্জামান হাসান বলেন, বৃষ্টির কারনে ঘরে ফিরতে সমস্যা হলেও গরম থেকে মুক্তি মিলেছে এই কত।
শার্শার আম চাষী আকতারুজ্জামান বলেন, তার প্রায় ১০ বিঘার আম বাগান রয়েছে। ঝড়ে অনেক আম পড়ে গেছে। এভাবে ঝড় হলে পথে বসে যেতে হবে।
যশোর সদর উপজেলার ঘুনিঘোপেরডাঙ্গা গ্রামের আম ও লিচু চাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২১ বিঘা আম ও লিচু বাগান রয়েছে। কয়েক দিনের তীব্র তাপদাহে ফলস পুড়ে গেছে। এর উপরে শুরু হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি। বৃহস্পতিবারে
ঝড় বৃষ্টিতে আম ও লিচুর কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে কারণে আম ও লিচু মাটিতে ঝরে পড়েছে।
পুলতাডাঙ্গা গ্রামের চাষি আমিন উদ্দিন বলেন, বুধবার দেড় বিঘা ধান কেটেছি। কিন্তু হঠাৎ ঝড় বৃষ্টিতে মাঠে ধান ভিজে গেছে। মাঠে বিঘার পর বিঘার ধান পেকে আছে। এভাবে বৃষ্টি হলে পাকা ধান ঘরে তুলতে ভোগান্তি পেতে হবে।
সদর উপজেলার আবদুলাপুর গ্রামের কৃষক আফসার উদ্দিন চার বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন। ৫ দিন পর ক্ষেতের ধান কাটার কথা ছিল তার। কিন্ত বৃহস্পতিবারে ঝড়ে তার ক্ষেতের ধানগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এতে ধান কিছুটা ঝরে গেছে। কাটতে ভোগান্তি পেতে হবে। খরচ বাড়বে। আফসার উদ্দিন বলেন, ‘কত কষ্ট করে আমরা আবাদ করেছি। আর যখন কাটার সময় হলো, তখন পাকা ধানে মই দিয়ে গেল ঝড়-বৃষ্টি।’
চৌগাছা উপজেলার মৎস্যরাঙ্গা গ্রামের ধানের গাছ নুয়ে পড়েছে। সেখানে কথা হয় ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি জানান, ঝড়-বৃষ্টিতে ধান নুয়ে পড়েছে। শুধু ধানগাছ না; আম ও লিচুর ক্ষতি হয়েছে।
যশোরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, ঝড়ে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এখন সেই তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই ঝড়ে কিছু জায়গায় ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। লিচু ও আমও ঝরে পড়েছে।’
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান , বাগেরহাট জেলা জুড়ে অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি নেমেছে। বৃহস্পতিবার এক পশলা বৃষ্টি ভুলিয়ে দিয়েছে দীর্ঘ দিনের দাবদহ।
মাসাধিককাল তীব্র তাপদাহ, কাঠ ফাটা রোদ আর অসহনীয় গরমে অতিষ্ট ছিল জনজীবন। কয়েক সপ্তাহের এই টানা অস্বস্তিকর অগ্নিদহনে যেমন প্রাণহীন হয়ে ওঠে চারপাশের প্রকৃতি অপর দিকে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল হয়ে ওঠে কস্টদায়ক আর অস্বস্তিকর। অবশেষে দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার পর বৃষ্টির মুখ দেখতে পেয়ে জনজীবনে বেশ স্বস্তি নেমে এসেছে।
বৃষ্টির কারণে মহাসড়কে যান চলাচল কমে যায়। তবে বর্ষার হওয়ায় অনেকে তড়িঘড়ি ঘরে ফিরতে ব্যবহার করেন রিকসা। ফলে রিকসা চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো। মৌসুমের প্রথম বর্ষার অনেকেই নিজের একটু ভিজিয়ে নিয়েছে।
বাগেরহাট শহরের বাসিন্দা মালেক শেখ বলেন, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বৃষ্টির ছোঁয়ায় শীতল পরশ পেয়েছি। টানা কয়েক দিনের গরমে জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল জীবন। এ বৃষ্টি অনেক স্বস্তি দিয়েছে সকলকে।
রিকসা চালক রফিক বলেন, প্রচণ্ড গরমে ঠিকভাবে রিকসা চালাতে পারিনি। আজকের বৃষ্টিতে শান্তি পেয়েছি, এখন যদি গরম একটু কমে। বর্ষায় নিজেকে একটু ভিজেয়ে নিয়েছি। অনেক ভাল লাগছে।
এদিকে যশোর ও সাতক্ষীরা ও মেহেরপুরে বজ্রপাতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা প্রত্যেকেই বোরো ধান গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে যশোরে ২ জন ও সাতক্ষীরার ২ জন এবং মেহেরপুরে একজন বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় ৪ জন মারা যান এবং একজন বুধবার রাতে মারা যান। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে ডেস্ক রিপোর্ট-
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, যশোরে মাঠে ধান তোলার সময় বজ্রপাতে আজিজুল ইসলাম (৩৫)নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে শার্শা উপজেলার পাড়ের কায়বা গ্রামের মাঠে এ ঘটনা ঘটে। আজিজুল ওই গ্রামের মৃত কামাল সরদার কিনুর ছেলে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, বৃষ্টিতে যেন ধান নষ্ট না হয় সেজন্যে বিকেলে আজিজুল তার ভাইসহ ৩/৪ জন মিলে স্থানীয় ঠ্যাংগামারী বিলের মাঠে নিজেদের জমির ধান গোছাতে যান। তারা মাঠে ধান গোছানো অবস্থায় বজ্রপাত হয়। এতে আজিজুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পাশে থাকা তার ভাই দেখে চিৎকার দেন। তখন স্থানীয়রা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত বাগআঁচড়ার জোহরা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আজিজুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
ক্লিনিকের ডাক্তার হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই আজিজুলের মৃত্যু হয়েছে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরার কলারোয়ার পাঁচরকি ও সদর উপজেলার বিহারীনগরে বজ্রপাতে ২ ব্যক্তি মারা গেছেন। নিহতরা হলেন, কলারোয়ার পাঁচরকি গ্রামের কামরুল ইসলাম (৩৬) ও সদর উপজেলার বিহারীনগর গ্রামের আব্দুল¬াহ মোল্যা (৩৪)।
স্থানীয়রা জানান বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলাব্যাপি কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়। সাথে ব্যাপক বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। এ সময় বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু হয়।
কলারোয়া থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বাড়ির পাশের বিল থেকে বোরো ধান উঠাচ্ছিলেন কামরুল ইসলাম। এসময় বজ্রবৃষ্টি শুরু হয়। বজ্রাঘাতে কামরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে মারা যান।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি আবু জিহাদ ফকরুল আলম খান জানান, ঝাউডাঙ্গা এলাকার বিহারীনগর গ্রামের আব্দুল¬াহ মোল্যা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। উঠানে আসা মাত্রই নারকেলগাছে বজ্রপাত হলে নিচে থাকা আব্দুল¬াহ গুরুতর আহত হন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মারা যান।
চৌগাছা প্রতিনিধি জানান, যশোরের চৌগাছায় মাঠে ধান ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে সাগর কুমার বিশ্বাস (২৪) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে পৌরসভার ৩নম্বর ওয়ার্ডের তারিনিবাস গ্রামের মাঠে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সাগর চৌগাছা পৌরসভার ৭নম্বর ওয়ার্ডের হালদারপাড়ার রবি কুমারের ছেলে।
পৌরসভার ৭নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহুল আমিন জানান, বুধবার রাতে সাগর তার বাবাসহ ৪ জন কপোতাক্ষ নদ পার হয়ে তারিনিবাস মাঠে নিজেদের জমির ধান গুছিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে যায়। ধান গুছানোর সময় বজ্রপাত হলে সাগরের শরীরে আগুন ধরে যায়। সাথে থাকা মৃত্যুঞ্জয় নামে আরেক যুবক অচেতন হয়ে পড়ে। এ সময় সাগরের বাবা ও ভাই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন এবং ডাক-চিৎকার দেন। তখন স্থানীয়রা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাগর কুমারকে মৃত ঘোষণা করেন।
চৌগাছা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মরত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার জুয়েল হোসেন বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই সাগরের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে তার শরীরের বামপাশ ঝলসে গেছে।
মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, মেহেরপুরের মুজিবনগরে বজ্রপাতে শাহাবুদ্দিন (৪০) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার দারিয়াপুর গ্রামের বিদ্যাধরপুর বাউনদা মাঠে তার মৃত্যু হয়। শাহাবুদ্দিন ওই গ্রামের স্কুল পাড়ার মৃত আলীমুদ্দিনের ছেলে।
মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী রাসেল জানান, বিকেলে শাহাবুদ্দিন নিজের জমিতে কাজ করছিলেন। এ সময় হঠাৎ বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। এক পর্যায়ে বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়।