মনিরুজ্জামান মনির : বাণিজ্যিক সবজি চাষে রাসয়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। সময় বাঁচাতে ও লোকসান এড়াতে কৃষকরা বিষের ব্যবহার করছেই। কোন কোন সবজিতে প্রায় প্রতিদিনই বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এমনকি কৃষি বিভাগের সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা (আইপিএম) মডেল ইউনিয়নেও কৃষকরা হরহামেশা বিষ প্রয়োগ করছেন। ফলে বাজারে বিষমুক্ত সবজি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কৃষি বিভাগ বলছে, ১০ জনকে জৈবনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করলে ২ জন ব্যবহার করছে, বাকিরা আবার বিষেই ফিরে যাচ্ছে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রের দাবি, সবজিতে বিষ প্রয়োগের মাত্রা আগের থেকে অনেক কম। বিশেষ করে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা(আইপিএম) সচেতেন কৃষকরা বিষ প্রয়োগ না করে ট্রাপ ব্যবহার করছে। এতেই তারা ফলন ভালো পাচ্ছে। সবজিও হচ্ছে বিষমুক্ত।
তবে কৃষি বিভাগের এ কথার সাথে মাঠের চিত্রের তেমন একটা মিল নেই। যশোর সদর উপজেলার সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা (আইপিএম) মডেল ইউনিয়ন লেবুতলার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা বিষের ড্রাম নিয়ে সবজিতে স্প্রে দিতে ব্যস্ত। এমনকি সপ্তাহে ২-৩ বারও স্প্রে করে থাকেন কৃষক। কোন কোন মাঠে অতিরিক্ত বিষক্রিয়ায় সবজি পুড়ে নষ্ট হতেও দেখা যায়। আবার দেখা গেছে, মাঠের পানির উৎসের পাশে কীটনাশকের খালি বোতল এবং প্যাকেটের স্তুপ।
স্থানয়িরা জানান, কীটনাশক স্প্রে করার সময় নুন্যতম স্বাস্থবিধিও মানা হয়না। শেষ হলে হাতে-মুখে সাবানও দেন না চাষীরা। যার কারণে নিজেরাও বিষের শিকার হচ্ছেন।
কৃষি বিভাগের মতে, যশোর জেলার সবজি বিভিন্ন জেলাসহ কয়েকটি দেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে। যশোরে আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর। এর মধ্যে শীত মৌসুমে ১৭ হাজার ৪’শ হেক্টর, গ্রীষ্মকালে ১৫ হাজার ৫’শ হেক্টর , আগাম চাষ ৭ হাজার ৬’শ ৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় লেবুতলা, হৈবতপুর, চুড়ামনকাঠি এবং ইছালি ইউনিয়নে। এ এলাকার সবজির মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, বাধাঁকপি, শিম, পটল, করোলা, লাউ ইত্যাদি। এ সবজি চাষে ব্যবহার হচ্ছে রকমারি কীটনাশক। বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে জানা অজানা বিভিন্ন কোম্পানির কীটনাশক।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কৃষক বিকেলে বিষ প্রয়োগ করে পরের দিন সকালে সবজি বাজারজাত করছেন। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন অন্তর কীটনাশক ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। সদরের বীর নারায়নপুর গ্রামের একজন কৃষকের দেড় বিঘা বাঁধাকপি পুড়ে গেছে অতিরিক্ত বিষ ব্যবহারের কারনে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, যশোর জেলায় খুচরা ও পাইকারি কীটনাশক বিক্রেতা আছে ১২০২ জন এবং সারের ডিলার আছেন বিএডিসি ১৬১ জন ও বিসিআইসির ১৪২ জন। মোট সারের ডিলারের সংখ্যা ৩০৩ জন। তবে যশোরের কৃষকেরা কি পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করছেন এমন তথ্য নেই কৃষি অফিসে। তবে তারা বলেন, কীটনাশকের ব্যবহার অনেক কমেছে।
হাঁপানিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সালাম জানান, ‘এবছর তিন বিঘা মতো সবজি চাষ করেছি। এক বিঘার মত ফুলকপির চাষ এবং দুই বিঘা পটলের চাষ করেছি। সবই বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে পোকা মারা হয়। বিষ প্রয়োগে শতর্কতা অবলম্বন করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমরা কৃষক সব সময় সতর্কতা ভাবে চলা সম্ভব হয় না, আবার মনেও থাকেনা। সব সময় না করলেও কোন কোন সময় মাস্ক ব্যবহার করি। বিষ প্রয়োগে আমাদের যে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে সেটা আমরা জানি।
এ বিষ থেকে আমাদের বাঁচার দরকার। কিন্তু কি করবো চাষে প্রতিযোগিতা করতে হয়। আমাদেরকে কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ এবং ইউলো ট্রাপ দেওয়ার জন্য নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করলে, হয়তো বিষমুক্ত সবজি চাষ করা সম্ভব ছিল। আইপিএম কায়দায় পোকা দমনের জন্য প্রথম পর্যায়ে খরচ বেশি হলেও পরবর্তীতে কোন খরচ হয় না। কারণ এগুলা একজন ব্যবহার করলে কোন লাভ হয় না। মাঠের সবাই ব্যবহার করলে ভালো কাজ হয়ে থাকে।’
কৃষক শরিফুল ইসলাম জানান, আগাম সবজির পোকা সহজে যায় না। যার কারণে খুব বেশি পরিমাণ বিষ স্প্রে করা লাগে। আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপিতে সপ্তাহে দুইবার স্প্রে করার পরও পাতা ছিদ্রকারি পোকা মারা সম্ভব হয়নি।
তিনি জানান, এক দেড় বছর আগে যখন আইপিএম ছিলো, তখন আমাদের মাঠে ফেরোমন সেক্স ট্রাপ খুব ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন আর ব্যবহার হয় না। কারণ এগুলো খরচের পরিমাণ অনেক বেশি এবং কাজও হয় একটু দেরিতে।
সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস জানান, খাবারে বিষ থাকলে আমাদের শরিরের জন্য মারাত্মক ক্ষতি। তবে সবজি পানিতে ভালো ভাবে ধোয়া হচ্ছে কিনা এবং আগুনের তাপমাত্রাটা সঠিক নিয়মে দেওয়া হচ্ছে কিনা এদিকে আমাদের খেয়াল করতে হবে। কীটনাশক বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। শাকসবজি এবং ফল পানিতে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে বিষক্রিয়া অনেকাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফল ও শাক সবজির মাধ্যমে আমাদের শরিরে খাবারে সাথে যে বিষ প্রবেশ করে তা ক্ষতিকর।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক(শস্য) আবু তালহা বলেন, এখন আগের থেকে কীটনাশকের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। আমরা বিভিন্ন মাঠে সবজিতে হলুদ ট্রাব ব্যবহার এবং বেগুনে নেটজাল দিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে মুক্ত করছি। আইপিএম এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বালাইনাশক যুক্তিযুক্ত প্রয়োগ করানো হচ্ছে। আমাদের কৃষকরা বিশেষ করে শাক জাতীয় সবজিতে বিকেলে স্প্রে করে সকালে বাজার জাত করে।
এগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি। বিষ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, মাত্রা বুঝে বিষ প্রয়োগ করছে ক্ষতি কিছুটা কম হয়। সাধারণত বিষক্রিয়া ৪ দিন থেকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এজন্য জৈবনাশক ব্যবহার করা অনেকটা নিরাপদ।