লাবুয়াল হক রিপন : কবিরাজ বলেছিল ‘রাজিব বেঁচে আছে। সে যেকোন দিন বাড়িতে ফিরবে।’ অপেক্ষায় ছিলেন দরিদ্র মা বাবা। অপেক্ষার ৭ বছর পর গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানিয়েছে সে আর কোন দিন বাড়িতে ফিরবে না। ফিরবে কিভাবে? ঘাতকরা তাকে মেরে পস্নাস্টিকের ড্রামে ভরে সেফটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়। ২০২২ সালের ৩০ মে যশোর পুলিশ সেই ড্রাম উদ্ধার করে পায় কংকাল। ৮মাস পর ডিএনএ টেস্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে তার পরিচয়। জানা গেছে তার হত্যা রহস্য।
গত বছরের ৩০ মে যশোর শহরের পুরাতন কসবা নিরিবিলি পাড়ার বজলুর রহমানের পরিত্যাক্ত জমিতে থাকা টয়লেটের রিং স্লাবের কুয়ার মধ্য থেকে পুলিশ উদ্ধার করে একটি প্লাস্টিকের ড্রাম। সেই ড্রামে মেলে পরিপূর্ণ কংকাল। কংকাল উদ্ধারের পর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। থানা পুলিশ নিজেদের মত তদন্ত করতে থাকে। এদিকে স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্তে নামে যশোর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তর দায়িত্ব পান এসআই জিয়াউর রহমান। তার দেয়া তথ্য মতে কংকালটি রাজিব হোসেন (৩২) নামে এক যুবকের বলে ডিএনএ টেস্টের প্রমান মিলেছে। রাজিবের পিতা খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনী মহল গ্রামের ফারুক হোসেন।
পিবিআই’র এসআই জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, সংসারে অভাব অনাটনের কারণে ২০১৫ সালে ছোট চাচা হাসমত আলীকে সাথে নিয়ে রাজিব খুলনা থেকে যশোরে আসেন কাজের সন্ধানে। এরপর পুরাতন কসবা মানিতলা মোড়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে তারা দুইজন দিন মজুরের কাজ শুরম্ন করেন। পরবর্তীতে পুরাতন কসবা আবু তালেব সড়কের সজিবুর রহমান নামে এক যুবকের একটি অফিসে এবং বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করতো রাজিব।
২০১৬ সালের ২৯ মার্চ রাজিব মোবাইল ফোনে তার পিতা ফারম্নক হোসেনের সাথে কথা বলেন। এ সময় রাজিব জানিয়েছিলেন তিনি বাড়িতে যাচ্ছেন। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতে না ফেরায় বিভিন্নস্থানে খোঁজখবর নিয়ে রাজিবের কোন সন্ধান পায়নি তার পরিবার। গরীব মানুষ হওয়ায় তারা মাঝেমধ্যে এলাকার বিভিন্ন কবিরাজের কাছে গিয়ে রাজিবের সন্ধান নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কবিরাজ তাদের বরাবরই জানায়, রাজিব বেঁচে আছে। যেকোনদিন বাড়িতে ফিরবে।
এরই মধ্যে ২০২২ সালে মে যশোর শহরের পুরাতন কসবা নিরিবিলি পাড়ার জনৈক বজলুর রহমানের পরিত্যক্ত জমিতে থাকা টয়লেটের রিং ¯স্নাবের কুয়োর মধ্যে পস্নাস্টিকের ড্রামে একটি কংকাল উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানার এসআই রফিকুল ইসলাম। ওই কংকালটি উদ্ধারের ঘটনায় থানা পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কিন্তু স্বউদ্যোগে বিষয়টি অনুসন্ধান শুরম্ন করেন পিবিআই’র এসআই জিয়াউর রহমান।
এই ঘটনায় যশোর পিবিআই অফিসে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ওই সাধারণ ডায়েরি আদালতের আদেশে অনুসন্ধানে নামেন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি জানতে পারেন পরিত্যক্ত ওই স্থানের পাশেই থাকতেন রিকসা চালক সালাম নামের এক ব্যক্তি। অনেক অনুসন্ধানের পর তিনি সালমাকে খুঁজে বের করেন। সালামের সহায়তায় জানতে পারেন ওই অফিসের ঠিকানা সেখানে রাজিব চাকরি করতো। তারপর অফিসের সকলের পরিচয় উদ্ধারের চেষ্টা করে পুলিশ। জানতে পারে রাজিব নামের একটি ছেলে নিখোঁজ আছে। খুঁজে বের করা হয় রাজিবের চাচা হাসমত আলীকে। তার কাছ থেকে পৌছানো হয় রাজিবের পিতা-মাতা ফারম্নক হোসেন ও মাবিয়া বেগমের কাছে।
ডিএনএ পরীড়্গার জন্য ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর তাদের পাঠনো হয় ঢাকার সিআইডি পুলিশের সদর দপ্তরে। সেখানে নমুনা দেয়ার পরে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি রিপোর্ট আসে। কংকালের ডিএনএর সাথে ফারম্নক হোসেন ও মাবিয়া বেগমের ডিএনএ ম্যাচ করায় পুলিশ নিশ্চিত হয় লাশটি তাদের ছেলে রাজিবের। গতকাল ১৭ জানুয়ারি এই ঘটনায় রাজিবের পিতা কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। তবে মামলায় পুরাতন কসবা আবু তালেব সড়কের সজিবুর রহমানকে আসামি করা হয়।
এরপর পুলিশ নামে মৃত্যু রহস্য উদঘটনে। তারা আবার ফিরে যায় সেই রিক্সা চালক সালামের কাছে। জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুস সালাম পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি সজিবদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থেকে রিক্সা চালাতেন। ঘটনার আগের দিন ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ তাকে দিয়ে একটি পস্নাস্টিকের ড্রাম কিনে আনেন অফিসের কর্তা সজিব। ২৯ মার্চ সন্ধ্যার পরে একটি লাশ ওই ড্রামে করে টয়লেটের রিং ¯স্নাবের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু কি কারণে রাজিবকে হত্যা করেছিল সেটা তার জানা নেই।
গতকাল মঙ্গলবার আটক আব্দুস সালাম এই ঘটনায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার দালাল জবানবন্দি শেষে তাকে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দিয়েছেন। আটক আব্দুস সালাম নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মঙ্গলহাটা গ্রামের মৃত নুরম্ন মিয়ার ছেলে। বর্তমানে তিনি যশোর শহরতলীর কিসমত নওয়াড়া গ্রামের আব্দার ড্রাইভারের বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন। পুলিশ এবার মামলার আসামী পুরাতন কসবা আবু তালেব সড়কের সজিবুর রহমানের সন্ধানে নেমেছে।