১লা ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
একটি সান্ধ্যভোজের গপ্প ।। শিল্পী নাজনীন (পর্ব:১)
90 বার পঠিত

বাড়িটা মো মো করছে খুব। নাক উঁচিয়ে ঘ্রাণটা টেনে নেয় ফেদি। মৃদু, চিকনসুরে ঘেউউউউ ডাকে খানিক গান গায় আকাশের দিকে মুখ তুলে। কণ্ঠ উপচে পড়া আনন্দটুকু দারুণ ছন্দে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অদূরে হুটোপুটিরত সদ্য বিয়োনো গোটা পাঁচেক ছানাপোনা কান ফেলে শোনে তাদের মা ফেদির এই আনন্দগীত । হুটোপুটি ছেড়ে দৌড়ে আসে সদলবলে। ফেদি শুয়ে পড়ে টান টান। তার ঝুলে পড়া, দুগ্ধভারে ফুলে ওঠা বানগুলোয় মুখ লাগিয়ে ছানাগুলো চুকচুক খায়, কুঁইকুঁই শব্দ তোলে সমস্বরে। যেন মার আনন্দগীতে সঙ্গত ধরে তারাও। তৃপ্তিতে বন্ধ চোখে পড়ে থাকে ফেদি। মাঝে মাঝে জিব বের করে ছানাপোনাগুলোর গা-গতর চেটে সাফ-সুতরো করে, মাতৃ¯েœহের উছল ধারায় ভিজিয়ে দেয় তাদের নধরকান্তি শরীর। এত যে খাদ্যের আকাল, ফেদির বানগুলো তবু দুধে টইটুম্বুর। ছানাপোনাগুলোর শরীরও চকচকে, দারুণ হৃষ্টপুষ্ট। গেল বছর ও পাড়ায় এক সাহেব এসেছিল, সাথে তার পোষা বিলেতি কুকুর টম। দেখেই প্রেমে পড়েছিল ফেদি। ভুতোর সে কী রাগ তাতে! পারলে ফেদিকে কামড়ে, ছিঁড়ে খায়। বলে, হারামজাদি ফেদি! তোর ’ক্যারেক্টার ঢিলা’! তুই একটা নচ্ছার মাগি!
ফেদি ও সব কানে তোলেনি তখন। তার মতো হাভাতে, হাড্ডিচর্মসার ফেদিকে যে বিলেতি সাহেব কুত্তা টম আদর করার ছলে কাছে ডেকেছে সেই বলে তার কত জন্মের ভাগ্যি! সেখানে পাড়ার চা দোকানে উঁচুস্বরে বাজা ’ক্যারেক্টার ঢিলা’ গান শুনে শেখা ভুতোর ওই মুখস্ত গালি পাত্তা দেবার সময় তার কই তখন! আলস্যে, তৃপ্তিতে, বোঁজা চোখ আধেক খুলে ছানাপোনাগুলোকে আড়চোখে দেখে আনন্দে আবার খানিক ঘেউউউ গান গায় ফেদি। বাপের মতো দেখতে হয়েছে সবকটাকে। পুরো বিলেতি একেকটা। ফেদি বা ভুতোর মতো হাভাতে, নেড়ি কুত্তার চেহারা নয় কারও। গর্বে বুক ফুলে ওঠে ফেদির। ভাগ্যিস, তাদের বাপ টম এসেছিল এ তল্লাটে, সাড়া দিয়েছিল ফেদির অমন উথাল পাথাল প্রেমে, নইলে কি আর এমন একপাল সাহেব কুকুরছানার মা হওয়া ভাগ্যে জুটতো তার! এ তল্লাটে আছে শুধু হাড় জিড়জিড়ে ভুতো আর ঠ্যাং ভাঙা টিকু। তাদের দেখলেই মেজাজ খারাপ হয় ফেদির, প্রেম তো দূর অস্ত। নেহাত একা একা জীবন চলে না, তাই তাদের সাথে মিল-মিশ করতে হয়, নইলে কে আর পাত্তা দিত ওসব বদখতদের! আর তাছাড়া টমটা ছিল দারুণ স্মার্ট, কত যে আদব-কেতা জানত! ফেদির মতো নেড়ি কুত্তির সাথেও সে কথা বলত অতিশয় আদব-লেহাজ নিয়ে, সাহেবের ফটর ফটর ইংরেজি বোলে সাড়া দিত কী যে দ্রুততালে! চলাফেরাও করত ভারি তমিজের সাথে। অথচ এরা! অসভ্য সব। বেত্তমিজ একেকটা। রাগে গা জ্বলে ফেদির। এই মরার দেখে কেন যে জন্মাতে গেছিল সে! জন্মাতো যদি টমের মতো বিলেতে! আহা! আফসোসে বড় একটা ঘেউ তোলে ফেদি। টমের জন্য মনটা তার ঘেউ ঘেউ করে এখনও। টম চলে গেল। যাক। ছানাপোনাগুলো তো তবু আছে। চেটেপুটে ছানাপোনাগুলোকে জবজব ভিজিয়ে দেয় ফেদি। টমের স্মৃতিচিহ্নগুলো। আহা।

আম্বিয়ার আজ সারাদিন ভারি ব্যস্ততা। দম ফেলানোর ফুরসত নেই একদম। সূয্যি ওঠার আগে, অন্ধকার থাকতে থাকতে এ বাড়িতে সেঁধিয়েছে সে, আজ এ বাড়িতে বিস্তর খানাপিনার আয়োজন, একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে তাকেই। একে তো গিন্নিমা গেঁটে বাতে কাহিল, তায় আবার আজ তার ধুমসি মেয়েটাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, হেঁসেলে ঢুকে মাঝে মাঝে তদারকি ছাড়া তিনি কিচ্ছুটি করছেন না আজ। আইবুড়ো মেয়েকে পাত্রস্থ করতে সকাল থেকে হলুদ বাঁটো রে, মেন্দি লাগাও রে, এটা আনো রে, ওটা ঘষো রে করতে করতে তেনার জান পেরেশান, হেঁশেলের ভার তাই আম্বিয়ার ওপর ছেড়ে তিনি নিশ্চিন্তে মেয়ের মুখের অম্যাবস্যা কাটিয়ে খানিক জোছনা ফোটানোর কসরতে মেতেছেন। আর আম্বিয়ার ওপর ভরসা করলে ঠকতে হয় না তাকে, জানেন তিনি।
উঠোনের কোণার দিকের দু পাশের দুই নারকেল গাছের সাথে খানিক উঁচুতে কাপড় শুকানোর দড়ি লম্বালম্বি টাঙানো। নিত্যদিনের ব্যবহার্য কাপড়গুলো তাতে সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি দোল খায় পলকা হাওয়ায়। মাগরিবের আযানের আগ দিয়ে সেগুলো তুলে রাখে আম্বিয়া। কিন্তু আজ দিনটা অন্যদিনের মতো নয়। বিশেষ দিন। আজ আয়েশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, তেমন হলে কাজি ডেকে আজই কলেমা পড়িয়ে তার আইবুড়ো নাম ঘুচানোর চেষ্টা করা হবে, হাবে-ভাবে বুঝেছে আম্বিয়া। দড়িতে তাই অন্যদিনের আটপৌরে কাপড়গুলো নেই আজ। কোনো অদৃশ্য যাদুমন্ত্রবলে তারা লুকিয়েছে তাদের রংচটা, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, বিষণœ মুখগুলো। বদলে সেই সকাল থেকে সেখানে ঝুলছে ঝা চকচকে এক গামছায় বাঁধা বহুবিধ সেদ্ধ মসলার পোঁটলা। সেই পোঁটলা থেকে ভুরভুর গন্ধ ছুটছে। সুযোগ পেলেই হারামি কুত্তি ফেদিটা তার ছানাপোনা নিয়ে এসে সেই সুগন্ধি পোঁটলার নিচে ঘেউ ঘেউ শব্দে বাড়ি মাথায় তুলছে যখন তখন। সেদিকে কড়া নজর রাখছে আম্বিয়া। কুকুর তার দু চোখের বিষ। নতুন বিয়োনো কুকুর আরও। বাচ্চাদের দুধ দিতে হয় বলে তাদের পেটে থাকে রাজ্যের খিদে। সে কারণে ছোঁক ছোঁক করতে থাকে দিনভর। চোখের সামনে যা পায় খেতে চায় রাক্ষসের মতো। সকালে গিন্নিমার কথা মতো সে বড় ডেগচি ভর্তি পানিতে পরিমাণ মতো পেঁয়াজ, রসুন, খোসা ছাড়িয়ে ফেলে তার সাথে ধনিয়া, আদা, জিরা আর এমনতরো হরেক মশলা নিয়ে জ্বাল করেছে আধাঘণ্টাটাক। বড় ছাঁকনিতে ছেঁকে মশলাগুলো গামছায় পোঁটলা বেঁধে কাপড় শুকানোর দড়িটাতে লটকে রেখেছে দিনভর। সারাদিনমান সেই পোঁটলা থেকে গন্ধ ছাড়ছে ভুরভুর। সারা বাড়ি মশলার গন্ধে একাকার। এই মশলা পরে বেঁটে মাংস রান্না হবে। খাসির মাংসে আলাদা মশলা মাখিয়ে রাখা হয়েছে। সেই মাংসে এই বাঁটা মশলা যোগ হবে। তারপর হাঁড়িতে চড়ানো হবে মাংস। সেই মাংসের স্বাদ হবে জব্বর। অনেকদিন লেগে থাকবে মুখে। পাত্রপক্ষ বহুদিন জিভের ডগায় নিয়ে ঘুরবে সে স্বাদ। ইচ্ছে হলেও ভুলতে পারবে না। ডেগচির মশলাসেদ্ধ সুগন্ধি জলটুকু গিন্নিমার কথামতো আম্বিয়া তুলে রেখেছে যতœ করে। পোলাও রান্না হবে সেই জলে। তাতে পোলাও হবে অমৃত। পোলাওয়ের ঘ্রাণেই অর্ধেক রসনাতৃপ্ত হবে পাত্রপক্ষের। আজ মোটে ফুরসত নেই আম্বিয়ার। এসব কাজে অবশ্য অন্যরকম এক আনন্দ হয় তার। সাথে কেমন একটা অ-সুখও গলার কাছটায় সুড়সুড়ি দেয়, চোখে এসে হামাগুড়ি দেয়। কান-মুখ লেগে আসে তখন। ব্যথা করে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে চায় হঠাৎ হঠাৎ। সাবধানে চোখ মুছে নেয় আম্বিয়া। গিন্নিমা দেখলে আর রক্ষে নেই। বকে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবেন আম্বিয়ার। বলবেন, আমার মেয়ের এমন দিনে তুই চোখের জল ফেলছিস রে হারামজাদি! আমার মেয়ের অমঙ্গল ডেকে আনছিস!

আঁচলে চোখ মুছে, ফোঁৎ করে বাঁ হাতে সর্দি ঝাড়ে আম্বিয়া। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ময়দা ময়ান করতে বসে সে। গাওয়া ঘিয়ে ময়দাগুলো পেলব হাতে মাখে। পাশে ডেগি মোরগের মাংসে মশলা মাখিয়ে বড় পাতিল ভর্তি করে রাখা।। পাত্রপক্ষ আসার সাথে সাথে তাদের নাস্তা দেয়া হবে। ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর ডেগি মোরগের ঝাল মাংস। জিভে জল আসতে চাইবে দেখেই। দ্রুত হাত চালায় আম্বিয়া। আর বেশি দেরি নেই। পাত্রপক্ষ এসে যাবে। তার অবশ্য সব রেডি। এখন শুধু চুলোয় বসাবে একে একে। সমস্যা শুধু হারামজাদি ফেদি। সে তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ পেলেই যে কোনো একটা কিছু মুখে নিয়ে পালায়। আর কুকুর বড় নাপাক। গু খেকো জানোয়ার। ওয়াক থু। কোনো কিছুতে মুখ লাগালে সেটা ফেলে দেয়া ছাড়া গতি নাই আর। সে কারণে আম্বিয়ার অসতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই একদম। হারামজাদিটা সেই সকাল থেকে জ¦ালিয়ে মারছে। না পেরে আম্বিয়া তাকে মুরগি আর খাসির বাতিল হাড়-হাড্ডি ছুড়ে দিয়েছে কতগুলো, খানিক আগে। ফেদিটা সেগুলো নিয়ে সরে গেছে আপোষে। ঘরের পেছনে বাচ্চাগুলো নিয়ে সেগুলোই চেটেপুটে সাবাড় করছে সম্ভবত। বাচ্চাগুলোর কুঁইকুঁই ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। ফেদিটাও একটু পর ঘেউউউ সুর তুলছে মনের আনন্দে। শুনতে পাচ্ছে আম্বিয়া। (……আগামী পর্বে সমাপ্ত)

সম্পাদক ও প্রকাশক : শাহীন চাকলাদার  |  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আমিনুর রহমান মামুন।
১৩৬, গোহাটা রোড, লোহাপট্টি, যশোর।
ফোন : বার্তা বিভাগ : ০১৭১১-১৮২০২১, ০২৪৭৭৭৬৬৪২৭, ০১৭১২-৬১১৭০৭, বিজ্ঞাপন : ০১৭১১-১৮৬৫৪৩
Email : samajerkatha@gmail.com
পুরাতন খবর
Fri Sat Sun Mon Tue Wed Thu
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  
স্বত্ব © samajerkatha :- ২০২০-২০২২
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram