নিজস্ব প্রতিবেদক : শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, প্রদীপ প্রজ্বালন, প্রতিবাদী গান আর কথামালায় যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার ২৫তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় বোমা হামলার স্থান শহরের টাউন হল ময়দানে রওশন আলী মঞ্চে বিচারহীনতার ২৫ বছর’ শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উদীচী জেলা সংসদ। অনুষ্ঠানে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত উগ্রবাদীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে শক্তিশালী দু’টি বোমা হামলা চালানো হয়। বোমার আঘাতে শিল্পীসহ ১০ জন নিহত এবং আড়াই শতাধিক মানুষ আহত হন। তাঁদের অনেকে স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
৬ মার্চ যশোর হত্যাকাণ্ড দিবস হিসেবে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী দিনটি যথাযোগ্য মার্যাদায় পালন করে আসছে। বুধবার সেই উদীচী ট্র্যাজেডি দিবস উপলক্ষে ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উদীচীর সভাপতি তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য।
বক্তব্য রাখেন মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য হাবিবা শেফা, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা অশোক রায়, জেলা উদীচীর সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিনুর রহমান হিরু, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বুলু, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু, উদীচী যশোরের উপদেষ্টা ইলাহদাদ খান, প্রেস ক্লাব যশোরের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সহ সভাপতি আব্দুল আফফান ভিক্টর।
বক্তারা বলেন, সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষকে জাগিয়ে তোলা, সচেতন করার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। তাই সংস্কৃতির শক্তিকে ধ্বংস করতে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী আঘাত হেনেছে সংস্কৃতির সেবক উদীচীর উপর; বিষয়টি পরিষ্কার। আমরা কোনো কোনো সময় আমাদের শত্রুদের চিনতে ভুল করলেও তারা কখনো ভুল করে না। তারা ঠিকই তাদের শত্রুদের চিনে নেয়; মনে রাখে।
যশোরে ২৫ বছর আগে উদীচীর বোমা হামলার ঘটনার আজও বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির ফলেই পরবর্তী সময়ে ছায়ানটের আয়োজনে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট বোমা হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বছর উদীচী এই হামলার শহিদদের স্মরণ এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে আসছে। কিন্তু বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। অথচ উদীচীর ওপর এ বোমা হামলা গোটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপরেই এক চরম আঘাত। প্রথম দিকে সবাই প্রতিবাদ—প্রতিরোধ, বিক্ষোভ প্রদর্শনে উদীচীর সাথী হলেও ক্রমান্বয়ে তা উদীচী ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শোক আর ক্রন্দনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা অতিমাত্রায় দলীয় আনুগত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে আছেন। আর চলছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আনুগত্য লাভের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
বক্তারা বলেন, ‘দুই যুগেও সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার দায় কি রাষ্ট্র কোনোভাবে এড়াতে পারে। আহত—নিহতের স্বজনেরা কি কেবলই কান্নার অনুরণন শুনতে থাকবে আর ক্রমান্বয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না, আমরা হতাশ হতে চাই না। সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সব অপতৎপরতা রুখে দাঁড়াতে হবে। যশোরে বোমা হামলার পুনঃতদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান বক্তারা।
আলোচনা শেষে মঞ্চের পাশে উদীচী বোমা হামলার নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এছাড়া স্মৃতিস্তম্ভে ১০ শহীদের স্মরণে ১০টি মশাল ও মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। রাতে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। শেষে ৬ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিচারহীনতার ২৫ বছর শীর্ষক নাটক মঞ্চস্থ হয়। এর আগে উদীচী হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেন উদীচী নেতৃবৃন্দ।